৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইতিহাস গড়ল আদনান আল রাজীবের সিনেমা ‘আলী’। প্রথমবারের মতো মর্যাদাকর এই চলচ্চিত্র উৎসবে অফিসিয়াল পুরস্কারে ভূষিত হলো বাংলাদেশের কোনো সিনেমা। স্বল্পদৈর্ঘ্য বিভাগে চলচ্চিত্রটি স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। পুরস্কার জেতার পর কান উৎসবের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন রাজীব। সিনেমাটি তিনি উৎসর্গ করেছেন সেইসব মানুষদের প্রতি, যাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং যাঁরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময় শনিবার (২৪ মে) দিবাগত রাতে অনুষ্ঠিত হয় এবারের উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান। এ সময় পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করে উৎসব কর্তৃপক্ষ। গৌরবোজ্জ্বল সেই মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে রাজীব বলেন, ‘এটা (পুরস্কার জেতা) আমাদের জন্য একেবারেই বিশেষ। অবশ্যই বাংলাদেশের জন্যও। এই প্রথম আমরা বড় কিছু অর্জন করেছি। আমি বলতে চাইছি, এটা একেবারেই অবাস্তব একটা ব্যাপার। কারণ, আপনারা জানেন বাংলাদেশ এই সময়ে খুবই অস্থির একটি পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে তা বিশুদ্ধ বাতাসের স্বাদ পাওয়ার মতো দারুণ। কানে (উৎসব) আসা এবং আমাদের জয়লাভ করা, এটা বাংলাদেশকে আশা ও ইতিবাচকতার বার্তা দেয়।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত একজন সাংবাদিক বাংলাদেশের প্রথম অফিসিয়াল পুরস্কারজয়, সিনেমাটির কোন বিষয়টি পুরস্কার জেতার নেপথ্যে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং ফিলিপাইনের সহ-প্রযোজনা ছাড়াও কি এই অর্জন সম্ভব হতো কিনা—এসব প্রশ্ন রাখেন রাজীবের কাছে।
আবেগাপ্লুত সেই মুহূর্তে রাজীব বলেন নিপীড়িত মানুষের কথা, যাঁদের প্রতি সিনেমাটি উৎসর্গ করেছেন তিনি। নির্মাতা বলেন, ‘যাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং যাঁরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, এই সিনেমাটি আমি তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করছি। আলী আসলে আওয়াজ তোলার কথা বলে, সব বাধা ভেঙে ফেলে নিজের অস্তিত্ব ও অবস্থানের পক্ষে কথা বলে। আমার মনে হয় এটা সবার জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি এই ছবি উৎসর্গ করছি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের আলীকে, যাঁদের কণ্ঠরোধ করা, যাঁরা কথা বলতে চায়। আশা করি এটি (আলী) তাদেরকে শক্তি যোগাবে, হয়তো তারা তাদের প্রকৃত কণ্ঠস্বরকে প্রকাশ করবেন।’
আলী’র গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ফিলিপাইনের কাইলা রোমেরো ও আরভিন বেলারমিনো। প্রযোজনা করেছেন বাংলাদেশের তানভীর হোসেন ও ফিলিপাইনের ক্রিস্টিন ডি লিওন। লাইন প্রোডাকশন কোম্পানি হিসেবে রয়েছে ‘রানআউট ফিল্মস’।
সিনেমাটিতে ফিলিপাইনের লেখক-প্রযোজকদের যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে রাজীব বলেন, ‘তারা দুর্দান্ত ভূমিকা রেখেছে, ফিলিপাইনের একজন প্রযোজক ক্রিস্টিন (ক্রিস্টিন ডি লিওন), সে আমার খুব ভালো বন্ধু। চিত্রনাট্যকার কাইলা রোমেরো, আরভিন বেলারমিনো—আমার অসাধারণ বন্ধু। ফিলিপাইন থেকে পোস্ট-প্রোডাকশনের সাপোর্টও পেয়েছি। সাউন্ড করেছি, গ্রেডিং করেছি; কারণ বাংলাদেশে ভালো প্রোডাকশন সিস্টেম নেই। তাদের সবার কাছ থেকে দারুণ সহায়তা পেয়েছি। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।’
শেষদিকে সঞ্চালক আবারও পুরস্কার পাওয়া অনুভূতি জানতে চাইলে রাজীব বলেন, ‘আমি যেমনটা বলেছি, এটা সবসময়ই অকল্পনীয়, অসাধারণ। কখনও ভাবতেও পারিনি যে এমন কিছু অর্জন হবে। আমরা শুধু আর্ট (শিল্প) করতে চেয়েছি, আমরা শুধু সৃজনশীল কিছু করতে চাই। এর সবকিছুই ইতিবাচক। আমার ভাষা নেই। কী বলব বুঝতে পারছি না। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। অবশ্যই আমার দেশের জন্যও।’
প্রসঙ্গত, কান উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা আলী প্রদর্শিত হয় গত শুক্রবার।
সিনেমাটিতে স্বনামে অভিনয় করেছেন আল-আমিন। অন্য একটি চরিত্রে রয়েছে ইন্দ্রাণী সোমা। ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে এক কিশোরকে কেন্দ্র করে। সে বেড়ে উঠেছে সমাজের এক কঠোর প্রথার ভেতর। যেখানে নারীদের গান গাওয়াকে অপমান হিসেবে দেখা হয়, সেখানে আলী নিজেই অংশ নিতে চায় একটি গানের প্রতিযোগিতায়। এই সরল আকাঙ্ক্ষার আড়ালে রয়েছে এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞা, যা প্রশ্ন তোলে লিঙ্গবৈষম্য, পরম্পরা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমারেখা নিয়ে।