পারকিনসন্স রোগ একটি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ। এ রোগ মস্তিস্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতির কারণে দেখা দেয়। পারকিনসন্স রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পেশি নিয়ন্ত্রণহীনতা, যা বিশ্রামের সময়ে মাথা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঁপতে থাকে, মন্থরতা, পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া এবং শরীরের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এ রোগে মানুষের একপর্যায়ে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হতে পারে।
এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো কী কী?
কাঁপুনি: প্রথমে কোনো আঙুল বা হাতে কাঁপুনি শুরু হতে পারে। ধীরে ধীরে তা শরীরের বাকী অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে কোনো সময়ে হয়ত একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখনও হাত অনবরত কেঁপে যাচ্ছে ৷ তাহলে চিন্তার কারণ আছে।
মন্থর গতিবিধি: পারকিনসন্স আক্রান্ত রোগীদের চলাফেরা মন্থর হয়ে যায়। সহজ কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। হাঁটার সময়, পদক্ষেপ ছোট হয়ে যেতে পারে বা চেয়ার থেকে উঠতে বা রাতে বিছানায় নড়াচড়া করতে অসুবিধা হতে পারে।
অনমনীয় পেশি: আপনার শরীরের যে কোনো অংশে পেশি শক্ত হয়ে যেতে পারে। শক্ত পেশি যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।
ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা: আস্তে আস্তে ঝুঁকে চলা বা বা হাঁটার সময় ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা হতে পারে।
স্বয়ংক্রিয় নড়াচড়ার অবনতি: শরীরের কোনও অঙ্গ নাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্য না থাকা বা হাঁটার সময় চোখের পলক ফেলা, হাসতে বা হাঁটবার সময় হাত না নাড়াতে পারার মতো সমস্যা দেখা দেওয়া।
কথা বলার সমস্যা: এই রোগে আক্রান্ত হলে ব্যক্তির কথা বলার ধরণ বদলে যায় । আস্তে আস্তে কথা বলা থেকে শুরু করে অস্পষ্ট কথা বলার সমস্যাও দেখা দেয় ।
হাতের লেখার পরিবর্তন: ছোট-ছোট লেখা, কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা যা পড়া মুশকিল হয়ে যায়।
তাছাড়া আরও অনেক লক্ষণ আছে, যা থেকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আভাস পাওয়া যেতে পারে।
ঘ্রাণশক্তি হ্রাস বা কমে যাওয়া পারকিনসন্স রোগের প্রথম লক্ষণ হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা বা ফোলাভাব। ঘুমের সমস্যা হতেও পারে। আবার দিনের বেলা তন্দ্রাভাব থাকা, এমনভাবে স্বপ্ন দেখা যেখানে ব্যক্তি হাত-পা ছুঁড়তে পারেন বা চিৎকার করতে পারেন। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা। প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঘনঘন প্রস্রাব পাওয়া বা তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।
বারবার পড়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া, ঠোঁট দিয়ে অনবরত লালা পড়তে থাকা, খাবার গিলতে সমস্যা, বমি বমি ভাব, স্বাদের পরিবর্তন অনুভব করা, যৌন কর্মহীনতাও পারকিনসন রোগের লক্ষণ হতে পারে। বিষণ্ণতাভাব, কোনও কিছু থেকে আগ্রহ হারানো, অকারণে ভয় বা উদ্বিগ্ন হওয়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়াও এই রোগের আগাম লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন।
পারকিনসন্স রোগের পর্যায়গুলো
পর্যায় এক:
একেবারে প্রাথমিক অবস্থায়, যাকে মৃদু পর্যায় বলা হয়। এই অবস্থায় শরীরে একপাশে হালকা অবশ অনুভূতি ছাড়া সেভাবে লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
পর্যায় দুই:
মুখের অভিব্যক্তি কিছুটা পরিবর্তন হয় অর্থাৎ হাসি-কান্নার মতো অভিব্যক্তি কমে যায়। শরীরের একপাশে হাত-পায়ে কাঁপুনি প্রকাশ পায়।
পর্যায় তিন:
এই পর্যায়ে রোগীর উপসর্গগুলো দ্রুত দৃশ্যমান হয়। রোগীর শরীর ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে চলাফেরা করতে গিয়ে রোগী বার বার পড়ে যান।
পর্যায় চার:
চতুর্থ পর্যায়ে এসে রোগী কোনো সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারেন না। রোগীর বিভিন্ন পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়। ফলে রোগীকে একা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
পর্যায় পাঁচ:
রোগী শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন বলা হয়। এই পর্যায়ে রোগী নিজে কিছুই করতে পারেন না। তখন রোগীকে হুইলচেয়ারে রাখতে হয় অথবা তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
এছাড়া চিকিৎসকরা বলছেন, পারকিনসন্স রোগে ভুগলে একপর্যায়ে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হতে পারে। তবে স্মৃতিভ্রম অর্থাৎ ভুলে যাওয়া বা ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ আলাদা রোগ।
পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হলে করণীয়?
এই ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই স্নায়ু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মস্তিষ্কের একটি এমআরআই প্রয়োজন হতে পারে ৷ রোগ নিশ্চিত হলে মস্তিষ্কে বা ব্রেনে ডোপামিনের মাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চিকিৎসক লেভোডোপা নামের ঔষধ এবং অন্যান্য ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। যা নিয়ম মেনে খেয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর ভালো হতে পারে। এই রোগের অ্যাডভান্স স্টেজে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস সার্জারি) এর মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসাও আজকাল সম্ভব ৷
নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসা
সর্বোচ্চ ওষুধের ডোজে যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে এই রোগের নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস সার্জারি) নামে এক ধরনের অপারেশন করা হয়। এই অপারেশনে রোগীর বুকের চামড়ার নিচে এক ধরনের ইলেট্রিক্যাল ডিভাইস লাগানো হয়। পরে সেই ডিভাইসের সঙ্গে ইলেকট্রিক্যাল তারের সংযুক্তির মাধ্যমে মাথার খুলি ছিদ্র করে ব্রেইনের ভেতরে তারের অন্য মাথা ঢোকানো হয়। অপারেশন ব্যয়বহুল হলেও রোগী অনেক ভালো থাকে।
যদি পারকিনসন্স রোগ হয়েই যায়, তাহলে আক্রান্তের কিছু সতর্কতা মেনে চলা জরুরি। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, ধীরে ধীরে হাঁটতে হবে, যেন মাথা ঘুরে পড়ে না যায়, ভারসাম্যহীনতা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সহযোগী রাখতে হবে রোগীর পাশে। পারকিনসনস রোগ পুরোপুরি ভালো হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে নিয়মিত ওষুধ সেবন, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, চট্টগ্রাম