ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত রোগ। মূলত স্ত্রী জাতীয় অ্যানোফিলিস নামক এক ধরনের মশার কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সেই ব্যক্তি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এ ছাড়াও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত কেউ যদি অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দান করেন, তাহলে সে ব্যক্তির দেহেও এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণের ধরণ অনুসারে ম্যালেরিয়া রোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় -
সাধারণ ম্যালেরিয়া
নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এ রোগের প্রধান লক্ষণ। নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে। যেমন- একদিন পর পর জ্বর আসে এবং ৩-৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয় এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভূত হয়, অনিদ্রা দেখা দেয়।
শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সময় অত্যধিক ঘাম হয়। বেশী বেশি পিপাসা লাগে। মাথাব্যথা, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ও তলপেটে ব্যথা অনুভূত হয়। খিঁচুনি হতে পারে। ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা। হজমের গোলযোগ দেখা দেওয়া। বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া। ডায়রিয়াও হতে পারে।
মারাত্মক ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া রোগের জটিল ধরণ হলো মারাত্মক ম্যালেরিয়া। জরুরি চিকিৎসা না পেলে এসব রোগীর মৃত্যু হতে পারে৷ মারাত্মক ম্যালেরিয়া রোগে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ দেখা যায় –
পানিশূন্যতা হওয়া। লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হওয়া। মাংসপেশি, প্লীহা ও যকৃৎ বড় হয়ে যাওয়া বা যকৃৎ বা লিভারের অকার্যকারিতা দেখা দেওয়া। শ্বাসকষ্ট হওয়া। কিডনির অকার্যকারিতা। খিঁচুনি। জন্ডিস। রক্তে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর বারবার বমি হয়। নিজে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে অসুবিধা হয় এবং কখনও কখনও রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।
ম্যালেরিয়া সংক্রমণের পর্যায়
প্রথম দিকে মাথাধরা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর শীত শীত অনুভূত হয় এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বর ১০৫°-১০৬° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক ঘণ্টা পর জ্বর কমে যায়। পরে আবার আসে। ৪৮ ঘণ্টা পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স দ্বারা সৃষ্ট ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ।
তৃতীয় পর্যায়ে রোগীর দেহে জীবাণুর সংখ্যা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেলে রক্তের লোহিত কণিকা ভাঙতে থাকে, ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যকৃৎ বড় হয় ও সংক্রমিত হয়। প্লীহা, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষা: ম্যালেরিয়া পরজীবীর লক্ষণ পরীক্ষা করার জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ম্যালেরিয়া নিশ্চিত ভাবে নির্ণয়ের জন্য রক্তের একটি মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা করা হয়।
দ্রুত ডায়াগনস্টিক টেস্ট (RDTs): RDTs একটি দ্রুত বিকল্প পরীক্ষা, ১৫-৩০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে নির্দিষ্ট ম্যালেরিয়া অ্যান্টিজেন শনাক্ত করা যায়। তবে, RDTs কিছু ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে পারে না, তাই ম্যালেরিয়া নিশ্চিতকরণ এবং নির্ধারণের জন্য রক্তের মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা অপরিহার্য।
ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা
রোগের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সংক্রমণের তীব্রতা আর ম্যালেরিয়ার ধরনের উপর এই রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে। সাধারণত তীব্রতা কম হলে ম্যালেরিয়া-প্রতিকারের জন্য মুখে খাওয়ার ঔষধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার (মারাত্মক ম্যালেরিয়া) ক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
এ রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী টিকা এখনো বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত নয়। তাই অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।
উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। ম্যালেরিয়া রোগে অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হলো সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়া এবং চিকিৎসায় বিলম্ব করা। সেজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে জটিলতা সৃষ্টির আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে করণীয়
মশাবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। মশার কামড় থেকে দূরে থাকাই এ রোগ প্রতিরোধের উপায়। এ ছাড়া
১. দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে।
২. দরজা-জানালায় মশা প্রতিরোধক জাল, শরীরে প্রতিরোধক ক্রিম, ঘরে মশা মারা স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।
৩. ঘরের আশপাশে কোথাও পানি জমে যেন মশা বংশবিস্তার না করতে পারে; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪. মশাবহুল স্থানে কীটনাশক ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
৫. ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারে এমন ঔষধ, যাত্রার পূর্বে সেবন করা উচিত।
ম্যালেরিয়া বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি, বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে। বিভিন্ন ধরনের ম্যালেরিয়া বোঝা, এর লক্ষণগুলি শনাক্ত করা এবং ঝুঁকির কারণগুলি জেনে এই গুরুতর রোগ প্রতিরোধ করতে এবং মৃত্যুর হার কমাতে দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসার সাথে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং বিভিন্ন গবেষণা, ম্যালেরিয়ার বৈশ্বিক বোঝা কমাতে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই রোগ সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে, আমরা এই জীবন-সংহারি রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং শেষ পর্যন্ত নির্মূল করার বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারি।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, চট্টগ্রাম