এ দেশের অনেক মানুষই চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ছোট হোক বা বড়, চাকরিজীবীর সংখ্যা নির্ধারণ করতে গেলে, তা বেশ বড় অঙ্কই দেখাবে নিশ্চিত। কিন্তু এই চাকরিজীবীদের মধ্যে সবাই যে পেশায় উন্নতি করতে পারেন, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারেন। আর বাকিরা পড়ে থাকেন সেই যে কে সেই অবস্থাতেই!
সাধারণত চাকরির শুরুতে থাকে প্রাথমিক পদ। ওইসব পদে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে পড়ে না। বরং নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করে যেতে হয়। আর এই পর্যায়টিতেই একজন চাকরিজীবীর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ধারিত হয়। অনেকে মনে করেন, এই পর্যায়ে শুধু নাক‑মুখ গুঁজে কাজ করে গেলেই হলো। এভাবে অনেকেই যেনতেনভাবে শুধু কাজটি করে যায়। ভাবে, ‘আমি তো আর সিনিয়র না। কাজ করলেই হলো!’ কিন্তু বিষয়টি এমন নয় কোনোভাবেই। বরং এই সময়টায় করা কাজের প্রকৃতিই একজন শিক্ষানবিশের ক্যারিয়ার গ্রাফ কেমন হবে, তা গড়ে দেয়।
সাধারণত ক্যারিয়ার বিষয়ক লেখাগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই কীভাবে নেতা হবেন, কেমন নেতা হবেন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ নেতা হওয়ার পূর্বশর্ত হলো অনুসারী হওয়া। ভালো অনুসারী হতে না পারলে কোনো নেতা যেমন ভালো নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে পারেন না, তেমনি নেতা হিসেবে অনুসারী তৈরিও করতে পারেন না। অবশ্য কীভাবে অনুসারী হবেন, সেই পরামর্শও খুব একটা দেওয়া হয় না। এর কারণ মূলত একটি। মানুষের মনে একটি সাধারণ ধারণা হলো—‘অনুসারী হতে আর কী কষ্ট! কথা শুনে গেলেই হলো।’ কিন্তু আদতে বিষয়টি তেমন নয়। এভাবে চললে দিনশেষে আপনি বনে যাবেন সাধারণ একজন কর্মচারী মাত্র! অনুসারী হওয়া তো হবেই না, বরং নেতা হওয়ার সম্ভাবনাও বাতাসে মিলিয়ে যাবে কর্পূরের মতো।
ফলোয়ার বা অনুসারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে শুধু কর্মীরা নিজেরাই যে বাধা সৃষ্টি করে, তা কিন্তু নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানও অনুসারী তৈরির ব্যাপারে উদাসীন থাকে। আমেরিকার সিয়াটল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দেখতে পেয়েছেন, যেসব ব্যক্তিদের বারবার অনুসারীর ভূমিকায় পদায়ন করা হতে থাকে, তারা মানসিকভাবে অসুখী বোধ করতে থাকে অধিক মাত্রায়। অফিসে সপ্তাহান্তের কোনো জরুরি কাজও তারা করতে চায় না। এমনকি সকাল সকাল অফিসে ঢুকেও কাজে তাদের মন বসে কম। এক্ষেত্রে নেতারা এগিয়ে। তার কারণও অনুমেয়। তাই উন্নত বিশ্বের কোম্পানিগুলো কর্মীদের মধ্যে এমন একটি মনোভাব সঞ্চারিত করার চেষ্টায় আছে, যাতে কর্মীরা প্রতিষ্ঠানকে ‘নিজেদের’ বলে ভাবতে পারে। বায়োটেক কোম্পানি ও ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মডার্না যেমন তার কর্মীদের বলেছে, নিজেদের মালিকানার হিস্যা বলে ভাবতে! এতে করে কর্মীরা নিজেদের কেবল ‘যন্ত্র’ বলে ভাবা বন্ধ করতে পারবে সহজে। এবং মডার্না বলছে, এই তরিকা কাজেও দিয়েছে ভালোই।
অনুসারী কয় ধরনের?
অফিস বা কর্মক্ষেত্রে সাধারণত ৫ ধরনের অনুসারী দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পাঁচ ধরনের কর্মীই সাধারণত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে থাকে। এরা সবাই অনুসারীই বটে, তবে ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার।
১. কিছু অনুসারী থাকেন একেবারে নিষ্ক্রিয়ভাবে, অনেকটা ব্যাঙের শীতনিদ্রার মতো করে। কোনো কিছুতেই এদের খুব একটা হেলদোল থাকে না। এরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেই না। আবার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিরোধেও এরা অংশগ্রহণ করে না। এরা এক ধরনের নির্জীব ভঙ্গিতে অফিস করে যায়।
২. কিছু অনুসারী থাকে ‘ইয়েস বস’ ধরনের। বসের সব কথাতেই এরা শুধু হাত কচলে আর ইয়েস বলেই ক্ষান্ত দেয়। এদের নিজেদের কোনো যুক্তিবোধ থাকে না, কোনো বিকল্প ভাবনাও থাকে না। এরা শুধু অন্ধভাবে আদেশ প্রতিপালনে ব্যস্ত থাকে।
৩. তৃতীয় ধারার অনুসারীরা সাধারণত বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির হয়। এরা নিজেরা ভাবতে পারে বটে, তবে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ভুল ধরাতেই সেই দক্ষতা সীমাবদ্ধ থাকে। এদের মুখে অনেক কথা থাকলেও, তা কাজে প্রস্ফুটিত হয় না।
৪. চতুর্থ ধারার অনুসারীরা বাস্তবিক হন। এদের মাথায় বুদ্ধি বা কাজের দক্ষতা থাকে ঠিকই, কিন্তু তাকে কাজে লাগান না। কোনো পরিবর্তন কীভাবে আনতে হবে, তা জানলেও সেই কাজটিতে উদ্যোগী হন না খুব একটা। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর অমাবস্যার চাঁদের মতো কদাচিৎ তাদের স্বরূপ দেখা যায়।
৫. আর কিছু অনুসারী থাকেন, যারা নিজেদের জন্য যেমন ভাবেন, তেমনি চিন্তা করেন প্রতিষ্ঠান ও এর কর্মপ্রক্রিয়া নিয়েও। এরা উদ্যোগী হন। নিজেদের ভাবনাকে কাজে লাগানোর চেষ্টার করেন সক্রিয়ভাবে। এ ধরনের কর্মীরা ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাধারণত। এরা অলস নন। সেই সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠভাবে সমালোচনা করতেও এরা জানেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের পুরো কর্মপ্রক্রিয়ায় এরা সক্রিয়ভাবে ও কার্যকর উপায়ে অবদান রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে, এই শ্রেণির অনুসারীরাই শেষ পর্যন্ত পরবর্তী নেতা বা উর্ধ্বতন হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকেন।
ভালো অনুসারী হতে কী করতে হবে?
ভালো অনুসারী হতে হলে অবশ্যই করিৎকর্মা হতে হবে। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে, ‘প্রোঅ্যাকটিভ’। এর অর্থ হলো, যে ব্যক্তি অফিসে কোনো কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য বসে না থেকে বরং সেটি সম্পন্ন করার জন্য সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, এ ধরনের কর্মীরা কাজ শুরুর আগেই তাতে অবদান রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে বেশির ভাগ চাকরিজীবীই এই কাজটি সাধারণত করেন না। উল্টো কাজ হয়ে গেলে প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই ভালো অনুসারী হতে হলে অবশ্যই ‘রিঅ্যাকটিভ’ না হয়ে ‘প্রোঅ্যাকটিভ’ হতে হবে। এটি পূর্বশর্তই বলা চলে।
ভালো অনুসারী হতে চাইলে কেমন গুণাবলী প্রয়োজন, তার আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। এতেই বুঝে যাওয়া যাবে যে, অফিসের ভালো অনুসারী হওয়া চাকরিজীবীরা আসলে কেমন হন।
প্রথমত, যেসব কর্মী ভালো অনুসারী, তারা কখনোই অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মী বা নেতার আশে‑পাশে ঘুরঘুর করে না। বরং ভালো অনুসারী ও নেতা, একে‑অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে যায়। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করায় এরা বিশ্বাসী হয়। কোনো প্রভু‑ভৃত্যের সম্পর্ক সেখানে থাকে না।
দ্বিতীয়ত, ভালো অনুসারীরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ হন। ভালোবেসেই তারা কাজটি করেন, শুধু বেতন পাওয়ার জন্য নয়। বরং কাজ করে আনন্দ না পেলেই এদের অস্বাভাবিক বোধ হয়। মনে রাখতে হবে, কেবল বেতন পাওয়ার জন্য কাজ করে গেলে, তা কখনও উন্নতি এনে দেয় না।
তৃতীয়ত, নেতা বা উর্ধ্বতনদের সাথে অনুসারীদের সম্পর্কটা বেশ বৈচিত্র্যময়। এরা একদিকে নেতার পেছনে করা গসিপ বা গুজবের প্রতিবাদ করে থাকে। সুযোগ পেলেই নিন্দা‑মন্দের পালে হাওয়া দেয় না। আবার নেতার যেকোনো সিদ্ধান্তকে প্রয়োজনে শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে চ্যালেঞ্জও করে। এমন অনুসারী দলে থাকলে তাই একজন নেতাও দিনকে দিন আরও দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন।
চতুর্থত, ভালো অনুসারী হওয়া কর্মীরা নিজেদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন আশা করেন। কাজ ভালো হলে যেমন প্রশংসা চান, পদোন্নতি চান, তেমনি কাজের দুর্বলতা তুলে ধরলে সেটিকেও ভুলভাবে গ্রহণ করেন না। এরা নিজেদের শক্তি‑সামর্থ্য ও দুর্বলতা—এই দুই বিষয়েই স্পষ্টভাবে জানতে ও সচেতন থাকতে চান। এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টাও এদের থাকে।
পঞ্চমত, যে কর্মী নিজেকে ভালো অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় থাকেন, তার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি বা উন্নতির প্রতি ঝোঁক থাকে। তবে কখনোই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে তা তারা চান না। বরং সেটিকে কীভাবে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়, তাই হয় তাদের প্রধান লক্ষ্য।
পরিশেষে…
এতক্ষণে জেনেই গেছেন নিশ্চয়ই, অফিসের কোন ধরনের কর্মীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল! এটিও ঠিক যে, কেমন অনুসারী হয়ে উঠবেন একজন ব্যক্তি, তা অনেকটাই তার বসের ওপর নির্ভর করে। অনেক নেতা চ্যালেঞ্জ পেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকে চান ‘জি হুজুর’ মানসিকতা। বস তো সব সময় নিজের মনের মতো পাবেন না। তবে নিজেকে কীভাবে তৈরি করে নিতে চান, সেটি কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ। আর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে নিজের উন্নতির বিষয়টি কিন্তু নিজেকেই বুঝতে হবে। বস সুবিধার না হলে এবং আপনার উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করতেই থাকলে, বস পাল্টে ফেলার বিকল্প উপায় তো আছেই! তা না করে নিজের উন্নতি আটকে যদি কেবলই মানিয়ে নিতে থাকেন, তবে কয়েক বছর পর আফসোস কিন্তু করতে হবে আপনাকেই। এবার, পছন্দ আপনার!
তথ্যসূত্র: বিবিসি, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, ইনডিড ডট কম, বেথেল ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ও ফোর্বস