বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রভাব আমাদের জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্মার্টফোন, ভিডিও অ্যাপ সব মিলিয়ে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংযুক্ত। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে এক বিশাল অনৈতিক ও অপরাধপ্রবণ ডিজিটাল ক্ষেত্র ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি। যা সমাজ, পরিবার এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটি শুধু সামাজিক বা নৈতিক সংকট নয়। দেশে এটি একটি আইনি অপরাধ। অথচ সচেতনতার অভাবে প্রতিদিন বহু মানুষ বিশেষত কিশোর-কিশোরীরা এতে জড়িয়ে পড়ছে আর নিজের অজান্তেই অপরাধী হয়ে উঠছে।
পর্নোগ্রাফি বলতে বোঝায় এমন ছবি, ভিডিও, অডিও বা লেখা, যা যৌন উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৈরি ও প্রচারিত হয় এবং সমাজের নৈতিকতা ও মানসিক সুস্থতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আইনি সংজ্ঞা
বাংলাদেশের ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ অনুযায়ী, পর্নোগ্রাফি বলতে এমন ভিজ্যুয়াল, অডিও বা ডিজিটাল কনটেন্টকে বোঝানো হয়েছে যা:
- যৌন চিত্র বা কার্যকলাপ দেখায়।
- যৌন উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হয়।
- জনসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয়।
আইন অনুযায়ী কোন কোন কাজ অপরাধ?
১. পর্নো ভিডিও বা ছবি তৈরি করা।
২. বিক্রি বা বাণিজ্যিকভাবে বিতরণ করা।
৩. সোশ্যাল মিডিয়া বা ওয়েবসাইটে আপলোড বা শেয়ার করা।
৪. কিশোর-কিশোরী (১৮ বছরের কম) ব্যবহার করে তৈরি করা।
৫. কাউকে ব্ল্যাকমেইল করতে ব্যক্তিগত ভিডিও ব্যবহার করা।
৬. কারও অজান্তে গোপনে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া।
এই অপরাধগুলোর জন্য ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে (ধারা ৮, ২০১২)।
শুধু শেয়ার করলেই কি অপরাধ?
- হ্যাঁ। অনেকেই মনে করেন ‘আমি তো বানাইনি, শুধু শেয়ার করেছি’ এটা ভুল ধারণা। আইনের চোখে শেয়ার করাও অপরাধ। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুসারে WhatsApp, Messenger, Telegram-এ কোনো পর্নো ভিডিও শেয়ার করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
- নিজের ফোনে সংরক্ষণ করাও অপরাধের আওতায় পড়ে।
কিশোর-কিশোরীদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি কোথায়?
বর্তমানে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নানা মাধ্যমে বন্ধুদের হাত ধরে, লিংকের মাধ্যমে বা ফেসবুক গ্রুপে পর্নোগ্রাফির সংস্পর্শে আসছে। এর ফলে তারা মানসিক বিকারগ্রস্ততা, পড়াশোনায় মনোযোগহীনতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা প্রবণতা, পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল ও সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ১৩-১৭ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে পর্নো কনটেন্টের সঙ্গে যুক্ত।
কেস ১
২০২৩ সালে খুলনায় ২১ বছর বয়সের এক তরুণ Discord ও Telegram গ্রুপ ব্যবহার করে ৩০+ নারীর অশ্লীল ছবি সংগ্রহ করে বিক্রি ও ব্ল্যাকমেইল করে। সাইবার ইউনিট অভিযানে তার মোবাইল ও ল্যাপটপ থেকে প্রায় ১৬৪টি পর্নো ভিডিও উদ্ধার করা হয়।
কেস ২
২০২২ সালে সিআইডি এক আন্তর্জাতিক চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে, যারা ১৮ বছরের কম বয়সীদের অশ্লীল ছবি সংগ্রহ করে Dark Web-এ বিক্রি করে। এদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৩১৬টি অশ্লীল ছবি ও ভিডিও উদ্ধার করা হয়।
কেস ৩
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তার বান্ধবীর ব্যক্তিগত ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।
পরিসংখ্যান
প্রতি মাসে গড়ে ২০০টির বেশি ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত অভিযোগ আসে পুলিশ সাইবার ইউনিটে (পুলিশ সদর দফতর, ২০২৩)। ৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীই নারী এবং ৭০ শতাংশের বয়স ১৫-২৫ বছর (BIGD Survey, 2022)। ৪০ শতাংশ সাইবার অপরাধমূলক মামলা পর্নো ও ব্ল্যাকমেইল সংক্রান্ত (Source: CID)।
ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম জানান, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী তরুণ-তরুণীরা অনেক সময় না বুঝেই অপরাধ করে বসে। তারা জানেই না কীভাবে ছবি শেয়ার করলেই ফৌজদারি মামলা হতে পারে।
চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডভোকেট রাফেয়া মাহমুদ জানান, নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। অনেকেই সংকোচ ও সামাজিক ভয়ে মামলা করেন না। আমাদের উচিত আইনি সহায়তা আরও সহজলভ্য করা।
কীভাবে নিরাপদ থাকবেন?
অপরিচিত লিংক, ভিডিও বা ফেসবুক গ্রুপ থেকে দূরে থাকুন। নিজের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য কাউকে পাঠাবেন না। শিশুদের জন্য parental control সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। অনলাইনে কারও অশ্লীল আচরণ দেখলে দ্রুত সাইবার ইউনিটে অভিযোগ করুন https://www.police.gov.bd/en/cyber_support_for_women। কেউ হুমকি দিলে ৯৯৯ বা সংশ্লিষ্ট থানায় জানাতে দ্বিধা করবেন না।
আইন জানুন, ভবিষ্যৎ রক্ষা করুন
পর্নোগ্রাফি এখন আর শুধু একটি অনৈতিক বা গোপন অভ্যাস নয়—এটি একটি অপরাধ, যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি কেবল মানসিক ও নৈতিক সংকট নয়, এটি আইনি ঝুঁকি। তাই আইনের জ্ঞান রাখি এবং সচেতন হই। সাহস করে অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। তবেই পর্নোগ্রাফির এই দৌরাত্ম্য থামানো সম্ভব।
লেখক: এলএলবি, শিক্ষানবিশ আইনজীবী।