একজন বাবা তার মেয়ের আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত এবং ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কারও বাবা বন্ধু হন, কেউ থাকেন কঠোর, আবার কেউ পরামর্শ দেন পথ দেখান। তবে সেরা অভিভাবক সেই, যিনি মেয়েকে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন গড়তে সাহায্য করেন।
বলিউডের তিন সুপারস্টার—শাহরুখ খান, সাইফ আলি খান এবং আমির খান। শুধু বড় অভিনেতা নন, ভালো বাবা হিসেবেও বেশ পরিচিত। তাঁদের মেয়েরা—সুহানা খান, সারা আলি খান ও ইরা খান। বাবাদের মতোই আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী তারাও। কিন্তু তাদের বাবাদের অভিভাবকত্বের ধরন ছিল একেবারে ভিন্ন। চলুন, দেখা যাক এই তিন বাবা, কীভাবে মেয়েদের বড় করেছেন এবং বাবা-মায়েরা এর থেকে কী শিখতে পারেন।
বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। মেয়েদের বেলায় বাবারা না কঠোর, না কোমল। এই সম্পর্ক যেন দোলাচলে দুলতে থাকে। এটি যেন কঠোরতার সঙ্গে স্বাধীনতার মিশ্রণ। একসময় যে বাবা তার ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে পথ চলেছেন, একদিন তিনিই তাকে নিজের পথে হাঁটার জন্য ছেড়ে দেন। কিন্তু যদি এই বাবারা হন বলিউডের রাজা? তাদের কি মেয়েদের ওপর নিজেদের খ্যাতির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া উচিত? নাকি তাদের নিজ নিজ পথে এগিয়ে যেতে দরজা খুলে দেওয়া উচিত?
শাহরুখ খান, সাইফ আলি খান এবং আমির খান—বলিউডের এই তিন সুপারস্টার শুধু সিনেমার জগতেই রাজত্ব করেননি, সেই সাথে তাদের মেয়েদের বড় করাটাও নিখুঁতভাবে সামলেছেন। সুহানা খান, সারা আলি খান ও ইরা খান—তিনজনই তাদের বাবাদের মতোই আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যা গড়ে উঠেছে তাদের বাবাদের ভিন্ন ভিন্ন অভিভাবকত্বের ধরণ থেকে। আসুন, দেখা যাক কীভাবে প্রতিটি খান তার সন্তানদের বড় করেছেন। তাদের মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে।
শাহরুখ খান: বন্ধু ও শেষ আশ্রয়স্থল
শাহরুখ খান শুধুমাত্র সুহানার বাবা নন, তিনি তার সবচেয়ে বড় সমর্থক, আবেগিক আশ্রয়স্থল এবং সবচেয়ে বড় বন্ধু। প্রচলিত কঠোর পিতৃত্বের পরিবর্তে, তিনি বরাবরই তাঁর সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি আমার সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি। যত বড় হচ্ছে, ততই বুঝতে পারছি, ওরাই আমার সেরা বন্ধু।’
এই পদ্ধতির ফলে সুহানা শিল্পীসুলভ স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন। যখন তিনি দ্য আর্চিস দিয়ে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করলেন, তখন শাহরুখ তার পাশে ছিলেন। কিন্তু কখনোই তার কৃতিত্ব নিজের করে নেননি। তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি সুহানাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কখনোই পুরোপুরি পারফেক্ট হতে পারবে না। কিন্তু নিজেকে যেমন আছো তেমনই রাখো, সেটা তোমাকে পারফেকশনের সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে যাবে।’
শাহরুখ সবসময় তার সন্তানদের ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তচিন্তার পরিবেশে বড় করতে চেয়েছেন। যাতে তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারে। বাবার আদর্শ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়। ফলে সুহানা আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের পথ বেছে নিতে পেরেছেন, বাবার খ্যাতির ভার তার ওপর পড়েনি।
সাইফ আলি খান: পথপ্রদর্শক ও বাস্তববাদী পরামর্শদাতা
সাইফ আলি খানের অভিভাবকত্বের ধরন হলো ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি একদিকে পরামর্শদাতা, অন্যদিকে বন্ধুর মতো নির্ভরযোগ্য। যখন সারা আলি খান বলিউডে আসতে চাইলেন, সাইফ তাকে সরাসরি সুযোগ দেননি। বরং তিনি তাকে অভিনয়ের ওপর মনোযোগ দিতে বলেছিলেন, খ্যাতির দিকে নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সারাকে সবসময় বলেছি অভিনয়ে মন দাও, স্টার হওয়ার দিকে নয়, আর সবসময় নিজের মতো থাকতে হবে।’
সাইফ তার মেয়ে বলিউডে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। কারণ তিনি নিজে খ্যাতির অস্থিরতা বুঝতেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন, ‘এই পেশা খুব একটা স্থিতিশীল নয়, আর সবাই এখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। কোনো বাবা-মা-ই এটা তার সন্তানের জন্য চাইবে না।’
তবে তিনি সারার সিদ্ধান্তেও বাধা দেননি। বরং তাকে নিজের পথ তৈরি করতে দিয়েছেন। তার বাবার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সারা বিনয়ী ও বাস্তববাদী হয়ে উঠেছেন। বলিউডের গ্ল্যামারের মোহ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
আমির খান: রক্ষনশীল বাবা থেকে উদারমনা
আমির খান তার মেয়ে ইরা খানের প্রতি বরাবরই সুরক্ষামূলক ছিলেন। শাহরুখের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ নন, সাইফের মতো নিরপেক্ষও নন—তিনি একসময় বেশ কঠোর ছিলেন। ইরা একবার বলেছিলেন, ‘আমার বাবা আমাকে কখনো সাঁতার কাটতে দিতেন না, সমুদ্রে কোমরের ওপরে যেতে দিতেন না। তিনি খুব বেশি রক্ষণশীল ছিলেন।’
কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমির নিজেও বদলেছেন। তিনি মেয়ের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আলোচনা করেছেন, এমনকি একসঙ্গে থেরাপিতে গিয়েছেন। আমির বলেছিলেন, ‘আমি ও ইরা একসঙ্গে থেরাপি শুরু করেছি, আমাদের সম্পর্ক আরও ভালো করার জন্য।’
এই অভিজ্ঞতা তাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। ইরা তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বরাবরই খোলামেলা, আর আমির তার পাশে থেকে তাকে বুঝতে শিখেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, বাবা-মেয়ের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে বদলায় এবং তার জন্য চেষ্টাও করতে হয়।
তিন ভিন্ন পদ্ধতি, এক অভিন্ন শিক্ষা
শাহরুখ, সাইফ এবং আমির—তিনজনের অভিভাবকত্বের ধরন আলাদা হলেও, তারা সবাই একটি বিষয়ে একমত—বাবা হিসেবে পরিবর্তনশীল হওয়া জরুরি। শাহরুখ সুহানার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন, সাইফ সারাকে স্বাধীনভাবে পথ চলতে শিখিয়েছেন, আর আমির ইরার সঙ্গে নিজেকেও বদলেছেন।
তাদের কন্যারা শুধু তারকা বাবার পরিচয়ে বেঁচে নেই, বরং তারা নিজেদের আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছেন।
বাবারা কী শিখতে পারেন?
শাহরুখ, সাইফ ও আমিরের অভিভাবকত্ব থেকে বাবা-মায়েরা অনেক কিছু শিখতে পারেন—
- শাহরুখের বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতি: সন্তানের আত্মবিশ্বাস গঠনের জন্য তাকে স্বাধীনতা দিন, তবে পাশে থাকুন।
- সাইফের ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা: সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে, তাকে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে দিন।
- আমিরের মানসিক সমর্থন: সন্তানের সঙ্গে আবেগিক যোগাযোগ গড়ে তুলুন, এমনকি প্রয়োজনে একসঙ্গে থেরাপিতেও যান।
সন্তানের পাশে থাকুন, তাকে বুঝুন, এবং তাকে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে দিন।
তথ্যসূত্র: টাইমস নাউ নিউজ