পৃথিবীতে বহু রকমের পণ্য ও সেবার ব্যবসা প্রচলিত আছে। প্রতিদিন নিত্যনতুন পণ্য ও সেবা যোগ হচ্ছে এই তালিকায়। তবে একটা নতুন ব্যবসা স্থান পেতে চলেছে এই তালিকায়। সেটা হলো নাগরিকত্বের ব্যবসা। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার একটা ভিত্তি ছিল এখনো আছে। কোনো দেশে জন্ম নেওয়া শিশু সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশে এই নীতি এখনো চালু আছে। এ ছাড়া যারা দীর্ঘকাল ধারে সেই দেশে কাজ করছে, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হয় অথবা যাদেরকে বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সেই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, পরবর্তীকালে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
কিছু দিন আগে মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোম বলে বিদেশি নাগরিকদের জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মালয়েশিয়ার ব্যাংকে জমা রাখলে তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আর ব্যবসা‑বাণিজ্য করার সুযোগ অবারিত করা হবে। তাই এই পদ্ধতি যে একেবারে পুরোনো, তা না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনলে তার বিপরীতে তাদের সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে থাকা ও কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। এটা ঠিক সরাসরি নাগরিকত্ব না হলেও নাগরিকত্বের অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।
কিন্তু সম্প্রতি যে বিষয়টা আলোচনায় স্থান পেয়েছে, তা হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাগরিকত্ব বিষয়ে খোলাখুলি প্রস্তাব। প্রস্তাবটা হলো, কেউ পাঁচ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬১.৫ কোটি টাকা) দিয়ে গোল্ডেন কার্ড কিনলে সহজেই আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে। এর আগে ইবি ৫ ভিসা প্রোগ্রামের অধীনে গ্রিনকার্ড দেওয়া হতো মূলত বিনিয়োগকারীদের, যারা এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ডলারের কিছু বেশি বিনিয়োগ করলে (বা ৮ লাখ ডলার নির্দিষ্ট চাকরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য), যা মার্কিন কোনো বাবসা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দশজনের পূর্ণকালীন চাকরি সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া রক্তের সম্পর্কের লোকদের স্পন্সরের মাধ্যমে বসবাসের সুযোগ পাওয়া যায়। অথবা বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন লোক, যিনি দক্ষতার কারণে নিয়োগ পেয়েছেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আগে অনেক কম অর্থ নিয়ে গ্রিনকার্ড দেওয়া হতো। যুক্তিটা হলো, গ্রিনকার্ডের মূল্য নাকি অনেক কম ধরা হয়েছিল। আর গ্রিনকার্ড নিয়ে নাকি চলেছে বেশুমার ছলচাতুরি। খুব সহজেই মিলে যেত গ্রিনকার্ড এবং তারপর সহজেই মিলত সেই বহু কাঙ্ক্ষিত মার্কিন নাগরিকত্ব, সুতরাং যুক্তিটা বেশ জোরালো। এভাবে বহু লোক সস্তায় গ্রিনকার্ড পেয়ে যাচ্ছে। মার্কিন কোষাগারে তেমন কোনো অর্থ জমা পড়ছে না। তাছাড়া গোল্ডকার্ডধারীরা নাকি সহজেই যে কাউকে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে পারবে, যা আগে ছিল সময়সাপেক্ষ আর নিয়োগকর্তাকে পোহাতে হতো নানা দাপ্তরিক জটিলতা। এসব জটিলতায় অনেক মেধাবী ছাত্র নাকি কাজ না পেয়ে তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেত।
গ্রিনকার্ড প্রাপ্তিটাও ছিল সবার জন্য খুবই জটিল একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন গোল্ডকার্ডধারী নিয়োগকর্তারা খুব সহজেই যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারবে। প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা ধনিক শ্রেণির মানুষদের আমেরিকার দিকে আকৃষ্ট করা। এ ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার থাকবে না। শুধু ৫০ লাখ ডলার হলেই মিলবে মার্কিন নাগরিকত্ব। এমনকি রাশিয়ার ধনকুবেরাও যদি চায় তবে অনায়াসে আমেরিকার নাগরিকত্ব নিতে পারবে। শুধু তাকে গুনতে হবে মাত্র ৫০ লাখ ডলার। মাত্র বললাম এ কারণে যে, বাংলাদেশের মতো দেশেও এটা খুব বড় কোনো অঙ্ক না এখন। এক সময় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন তাঁর অফিসের পিয়নের নাকি চার শ কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। তাহলে আর বলার অপেক্ষা রাখে না অন্যদের কার কী আছে। এই পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই ট্রাম্প ও তাঁর সাঙাত ইলন মাস্কের কাছে আছে। এখানে শুধু বাংলাদেশের কথা বললাম। এর বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় এ রকম অনেক বাংলাদেশ আছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও এদের অস্তিত্ব খুব কম না। ভারত একবার এই কালো টাকার মালিকদের শায়েস্তা করার জন্য হাজার টাকার নোট নিষিদ্ধ করে। ফলাফল কী হয়েছিল জানি না। তবে তাদের অস্তিত্ব বিপুল মাত্রায় ছিল বলেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। যা হোক আমেরিকার ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্টকে সাধুবাদ জানাতে হয় যে, তিনি ব্যবসার একটা ভালো ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছেন। তাদের অনুমান, প্রায় ১০ লাখ লোক এই ডাকে সাড়া দেবে। এই দশ লাখ লোকের ৫০ লাখ করে অর্থ যোগ করলে তা ট্রিলিয়ন বা লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমেরিকার অর্থনীতি স্ফীত হবে। বিপুল ঋণ পরিশোধের দায় মেটানো যাবে খুব সহজে।
এখন কথা হলো, কারা এই সুবিধা গ্রহণ করবে। লক্ষ্য হলো বিভিন্ন দেশের ধনীরা। দেশে দেশে এদের অভাব নেই। কিন্তু এই ধনীদেরই তো মার্কিন নাগরিকত্বের প্রয়োজন। যদি বলি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন অথবা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান অথবা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর নাগরিকদের এবং যাদের প্রচুর বৈধ সম্পদ আছে দেশে–তাদের কি মার্কিন নাগরিকত্ব খুবই দরকার? উত্তর, না। দরকার মূলত তৃতীয় বিশ্বের চোর, ডাকাত, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের। কারণ তাদের একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশের মানুষ এখন ব্যাপারটা খুব ভালো বোঝে। এই লোকদের দরকার এই ধরনের একটা ব্যবস্থা, যেটা তাদের চোরাই অর্থের পূর্ণ নিরাপত্তা দিবে। সোনার বাংলায় যেটা বলে চোরের দল। সেই থলেদারের ভূমিকা পালন করবে যুক্তরাষ্ট্র, এই গোল্ডকার্ডের মাধ্যমে। আমেরিকা দেশটার উন্নতির মূলে ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিভাবান অভিবাসী মানুষ, যারা আমেরিকাকে তাদের দেশ করে নিয়েছেন। তাদের শ্রমে আর মেধায় উন্নতির চরম শিখরে উঠছে এই দেশ। এক সময় সুইস ব্যাংক বিশ্বের সব নামি-দামি চোর আর মাদক চোরাকারবারিদের অর্থের নিরাপদ ঠিকানা ছিল। এখানে রাখা অর্থের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা আর নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, কিন্তু নাগরিকত্বের কোনো সুবিধা ছিল না। এখন এই গোল্ডকার্ড চোরাই অর্থ আর চোরের নিরাপত্তা–দুটিই নিশ্চিত করছে।
তবে এভাবে যদি আমেরিকার অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে, তাতে অন্য কার কী হলো বা কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমেরিকা যদি দলে দলে অভিবাসীদের ফেরত পাঠায়, তাহলে মেধাবীরা বুঝতে পারবে মার্কিন মুল্লুক আর এখন তাদের জন্য না। তবে নিশ্চিতভাবে তাদের ওপর অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে। অন্যদিকে দশ লাখের মধ্যে যদি এক লাখ চোর-ডাকাতও ঢুকে পড়তে পরে, তবে তারা সেখানেও অপরাধের রাজ্য গড়ে তুলবে।
ফলে আমেরিকার মেধাবীদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে চোরের রাজ্যে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ১৮৭০ থেকে ১৯০০ সাল গিল্ডেড এইজ নামে পরিচিত হয়েছিল। এর বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দুরাচার, বিশাল আয়বৈষম্য আর বিপুল অভিবাসীর আগমন। আমেরিকা সম্ভবত আবার সেই গিল্ডস এইজে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সময়ই সবকিছু বলে দেবে। সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক আর বাণিজ্যিক চিন্তা সব সময় ভালো ফল দেয় না। বিশ্ব মোড়ল হিসেবে টিকে থাকতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনেক কিছু ভাবতে হবে।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষক ও গবেষক
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]