‘ধন লোভী সিন্দুকের চাবি
চোরার কাছে থাকে না
কাউয়ায় কমলা খাইতে জানে না…’
বেশ বিখ্যাত একটি গান এটি। এ দেশেরই। রাজ্জাক দেওয়ানের এই গান ইদানিংকালে মুক্তি পাওয়া এক সিনেমাতেও ব্যবহার করা হয়েছে। আর কি অদ্ভুত বিষয়! কিছুদিনের মধ্যেই আমরা একে একে এমন সব জাতীয় ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি যে, বার বার মাথার ভেতরে কেউ যেন গেয়ে উঠছে, আসলেই কাউয়ায় কমলা খাইতে জানে না!
কাউয়া মানে কাক। আর কমলা তো চেনেনই সবাই। অর্থাৎ, কাকের কপালে কমলা নেই। কারণ কমলা পেলেও তা খাওয়ার তরিকাই যে জানে না কাক। এর গূঢ় অর্থ হলো, অযোগ্য মানুষের হাতে যোগ্য জিনিসের কোনো দাম নেই।
চাইলেই এই পুরো গানটিকে জাতীয় রূপক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমরা জাতিগতভাবেই কেন জানি কাউয়া হয়ে যাচ্ছি। কয়েক মাস আগেও একজন সুপরিচিত রাজনীতিককে নিয়ে তামাশা করতে এই বিশেষ্য ব্যবহার করা হতো। তা নিয়ে মানুষ বেশ আমোদও পেত। আসলে যখন মানুষের আর কিছু করার থাকে না, তখন বিদ্রূপ উপস্থিত হয় মরিয়া রূপে। বাংলাদেশে তা সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ট্রলই যেন আমাদের অন্যতম প্রধান বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয়ও বিবেচনাযোগ্য। সেটি হলো, এ দেশের মানুষ হিসেবে আমরাও কেন জানি এমন সব ঘটনারই উৎপাদন করছি, যা পরবর্তীতে এত খেলো হয়ে যাচ্ছে যে, নিজেদের কাউয়া ভাবাটাই যথার্থ হয়ে উঠছে। আমরা যথেষ্ট অহেতুক কারণ সৃষ্টি করেও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে পিছপা হই না। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই চিল না দেখতে পেলেও ছুটতে থাকি। আবার মহৎ ও ন্যায্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেও তাকে নিমেষে পুরোপুরি অন্যায্য ও অন্যায় রূপ দেওয়াতেও মোদের জুড়ি নেই।
সাম্প্রতিক ঘটনার দিকেই দৃষ্টিপাত করা যাক। আমাদের দেশের সাকিব–বুবলি–পিয়াদের মতো তারকারা অনলাইনে চালান জুয়ার প্রচারণা। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এ নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে। অথচ তাঁরা তারকা এবং এ দেশের অসংখ্য মানুষ তাঁদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফলো করার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা নানা সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে নসিহতও দেন। এখন তাঁরাই যদি এ দেশে নিষিদ্ধ জুয়ার প্রচারণা চালান নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক–ইউটিউব–ইনস্টাগ্রাম আইডি’তে, তাহলে সাধারণ মানুষ শিখবে কী?
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যাই হলো, এ দেশে আদর্শ নায়ক বা ব্যক্তিত্বের অভাব। আমরা যাদের আইডল বানাই, সময়ের ফেরে তারাই এমন রূপ পরিগ্রহ করে যে, শ্রদ্ধার বারোটা বেজে যায় একেবারে। তারা এমন সব কাজ করতে থাকেন যে, আগে জানানো ‘সহমত’ বা ‘অতল শ্রদ্ধা’ বদলে হয়ে যায় চরম অশ্রদ্ধা। আমজনতার উল্টো মনে হতে থাকে যে, আগে যে কেন এত পছন্দ করেছিলাম!
আমজনতার অবস্থাও অবশ্য সুবিধার না। গাজা প্রসঙ্গেই আসা যাক। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নারকীয় হামলা চালানো হচ্ছে, একেবারে নিকেশ করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েলসহ অন্যরা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–বিক্ষোভের ডাক এল, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই মূলত। সেটি পালন করাও শুরু হলো। নানা শ্রেণি–পেশার মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দেওয়া স্লোগানে মুখরিতও হলো সারা দেশ।
অথচ ঠিক তার পরই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়ে গেল অহেতুক ভাঙচুর, সহিংসতা। বিভিন্ন স্থানে বাটা, কেএফসি প্রভৃতি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শোরুমে হামলা চলল। এসব প্রতিষ্ঠানকে ইসরায়েলি দাবি তুলে আবারও চলল মব সন্ত্রাস। আরও পরিতাপের বিষয়, আমরা দেখতে পেলাম বেশুমার লুটপাট। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদনেই দেখা গেল যে, হামলাকারীরা বাটা’র শোরুম থেকে জুতা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে এবং সগৌরবে! কোথাও আবার কোমল পানীয়ের বোতল লুট করে নিয়ে এসে রাস্তায় ফেলে তথাকথিত ‘প্রতিবাদ’ করা হলো। আর ভাঙচুর তো চলল ইচ্ছামতো।
আচ্ছা, এসব করার সময় কি একবারও ভাবা হয়েছে যে, যেসব প্রতিষ্ঠানে এমন কাজ করা হলো, সেসবে আমাদের দেশেরই মানুষ চাকরি করেন? ওই চাকরির টাকাতেই তাদের পরিবার চলে? ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙেই যদি দেওয়া হয়, তবে তাদের রোজগার কীভাবে হবে? না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা কি তাদের তৈরি হবে না?
ভিডিও দেখুন:
আর জুতা লুটের প্রসঙ্গে তো কিছু বলাই কঠিন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে এ দেশের মানুষের নির্লজ্জ লুটপাট। এবং প্রতিবাদী ও বিক্ষুব্ধ মিছিলের পর পরই এসব হয়েছে। একটা ভিডিওতে একজনকে খেদের সঙ্গে বলতে শোনা যায়, ‘…সবাই চুর এখানে…’!আর এটা শোনার পরই খুবই অসহায় ভঙ্গিতে কানে থাকা হেডফোন খুলে ফেলতে হয়। মোবাইল ফোনের স্পিকার অন থাকলে অফ করে দিতে হয়। শুনতে ইচ্ছা করে না সত্যি। এই কথাগুলো কানে ঢোকে তরল বিষের মতো করে। তবে কি আমরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে চৌর্যবৃত্তি ও লুটপাটতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি? আমার দেশেরই আরেকজন মানুষ যখন এসব সহ্য করতে না পেরে বলে ওঠেন, ‘…সবাই চুর এখানে…’, তখন বিদেশিরা এই ভিডিওচিত্র দেখে কি বলবে? বাংলাদেশের মানুষদের কী ভাববে? বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ভাববে? সবাই ‘চুর’ এখানে?
ভিডিও দেখুন:
ওহ্ হো, মারামারি–ভাঙাভাঙি না করতে পারলে তো আবার আমাদের ক্ষোভে জোশ থাকে না। এ কারণেই হয়তো এদেশীয় সিনেমায় নায়িকা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ক্লাইম্যাক্সে বলে ওঠেন—‘মারো, মারো’। ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব, কোনো কিছুই আমাদের সংঘাতমুখর আচরণে রাশ টানতে পারে না। ঈদের পর পরই শরীয়তপুরের জাজিরার একটি ছোট্ট এলাকার দুই প্রভাবশালীর ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারের খেলায় তাই শতাধিক লোক জড়িয়ে যায়। বিস্তীর্ণ ফসলের খেত হয়ে পড়ে সিনেমার যুদ্ধক্ষেত্র। বালতি বালতি ককটেল তারা ফোটাতে থাকে। দুই পক্ষে আহতও হয় অনেকে। যদিও যাদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই সংঘাত, তারা থাকেন আরামেই। যে দেশে নিজেদের জান বাজি রেখে কেবলই অন্যের ব্যক্তিগত আধিপত্যের রক্ষায় এত মানুষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে, যুদ্ধের ‘ফিল’ দিতে পারে দেশবাসীকে—সে দেশে আর যাই হোক, মস্তিষ্কের চর্চা যে খুব একটা আদরণীয় নয়, সেটি নিশ্চিত।তাই দিনশেষে মাথায় ঘুরতে থাকে রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা গানের কলি। বার বার শোনা হয়, ‘কাউয়ায় কমলা খাইতে জানে না… জানে না…’। গান শুনতে শুনতে, আর জাতীয় জীবনের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে ধন্ধে পড়ে যেতে হয় অবচেতনভাবেই। মনে ভিড় করতে থাকে দ্বিধার কালো মেঘ, তাতে বিট লবনের মতো ছেটানো থাকে ভয়। কবে যে মুখ খুলতে গেলেই আমাদের কন্ঠে বেজে উঠবে কাউয়ার কা কা, তার জন্যই যে এখন শঙ্কাজর্জর মনে অপেক্ষা!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]