‘বাসে আটকে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, চালক ও সহকারী গ্রেপ্তার’, (প্রথম আলো)
‘স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ, প্রেমিক আটক’, (বাংলা ট্রিবিউন)
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যুবদল নেতার হুমকিতে বাড়িছাড়া’, (ডেইলি স্টার বাংলা)
‘মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টা: পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা’, (চ্যানেল আই অনলাইন)
‘সিরাজগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’, (জাগো নিউজ)
গত ৪৮ ঘণ্টায় এসব ঘটনা ঘটেছে এ দেশে। ঘটনা আরও আছে। গুগল সার্চে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি লিখে সার্চ দিলে শুরুতে এগুলো আসছে। গভীরে গেলে আরও সংবাদ পাওয়া যাবে। ওপরে শুধু কতিপয় খবরের শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে। খুঁজলে হয়তো এমন আরও অনেক ঘটনা পাওয়া যাবে। আর ধর্ষণের বদলে নারী নির্যাতনের বিষয়ে খোঁজখবর নিলে তালিকা নিশ্চয়ই আরও বড় বৈ ছোট হবে না।
এসব ঘটনা গত কয়েক মাস ধরেই আমাদের এই দেশে ঘটে চলেছে। এর বাইরে আমরা প্রায় সময়ই শুনছি, দেখছি নারীর প্রতি নিপীড়ন ও নির্যাতনের আরও নানা অভিনব উদাহরণ। মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশে নারীদের প্রতি নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা চরম আকার নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বেড়েছে, বেড়েছে সহিংসতা ও নৃশংসতাও।
আরও পড়ুন:
এই তো গেল ঈদের সময়ই খোদ রাজধানীতে একজন নারী সাংবাদিক হেনস্তার শিকার হলেন। বনশ্রীর একটি দোকানে জুস খেতে গিয়েছিলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার ওই সাংবাদিক। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই এবং আরেক দৈনিক পত্রিকার এক সাংবাদিক। ওই সময় এলাকার কয়েকজন বখাটে ছেলে নারী সাংবাদিককে ইভটিজিং ও হেনস্তা করে। এর প্রতিবাদ করায় বখাটেরা ওই নারী সাংবাদিকের ছোট ভাইকে মারধর করে। ভাইকে বাঁচাতে গেলে হামলা হয় নারী সাংবাদিকের ওপরও। তখন সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হুমকিও দিয়েছিল বখাটেরা।
হ্যাঁ, এটি ঠিক যে ওই ঘটনায় বেশ ত্বরিৎ গতিতেই ব্যবস্থা নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, রাজধানীর রাস্তাতেই একজন নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করার মতো সাহস পেয়েছে বখাটেরা। সেখানে একেবারেই সাধারণ নারীদের, যাদের প্রতিনিয়ত জীবনের প্রয়োজনে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে হয়, তারা তাহলে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
অর্থাৎ, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নারী নির্যাতনকারীরা বর্তমানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে বাড়ছে নারীদের প্রতি নিপীড়নও। এ‑সংক্রান্ত সাম্প্রতিক হিসাবে একটু চোখ বোলানো যাক।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক প্রতিবেদনে (মার্চ) জানানো হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে ২৪৮ জন কন্যা ও ১৯৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২৫ জন কন্যাসহ ১৬৩ জন। তার মধ্যে ১৮ জন কন্যাসহ ৩৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২ জন কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ২ জন কন্যা ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া ৫৫ জন কন্যাসহ ৭০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মার্চ মাসে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১২ জন কন্যাসহ ১৬ জন। উত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ৮ জন, এর মধ্যে ৬ জন কন্যা। বিভিন্ন কারণে ৯ জন কন্যাসহ ৫৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল মার্চ মাসে দেশে শিশু ও নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেতিবাচক দায়িত্ববোধ, ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে অপারগতার ফলে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যে হারে বেড়ে চলেছে, তা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন।
আরও পড়ুন:
এই গুরুতর পরিস্থিতিও কিন্তু হুট করে তৈরি হয়নি। চলতি বছরের শুরু থেকেই এ‑সংক্রান্ত ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে সামনে আসছিল। এমনকি গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালেও পরিস্থিতি সুবিধার ছিল না মোটেও। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। গত বছর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী। এ ছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ৫২৩ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ১৭৪ জন।
সুতরাং, নারীদের ক্ষেত্রে একটি ক্রমাবনতিমূলক পরিবেশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টি এমন নয় যে, হুট করে হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রতিরোধের ও প্রতিকারের কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, আলোচিত ঘটনা ঘটলে সরকারের পক্ষ থেকে লম্বা‑চওড়া কথা শোনা যায়। নানা আগডুম‑বাগডুম পদক্ষেপ নেওয়ার বাণী আসে। কিন্তু ক’দিন পর আবার যে কে সেই! এই দেশে যেকোনো সরকারই কেন জানি পরিস্থিতি সামলানোর এই সস্তা ফরমুলাটি শিখে ফেলে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এরপর চলে প্রয়োগ। অপেক্ষা তখন কেবল কোনোমতে জনক্ষোভ প্রশমিত হওয়ার। তারপর আবার সব চলতে থাকে আগেরই পন্থায়।
আরও পড়ুন:
এ কারণেই মাগুরার ৮ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় যখন সারা দেশে আলোড়ন ওঠে, সাধারণ মানুষ যখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখন আছিয়ার মরে যাওয়ার দিনে সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা বলে দেন, মামলার বিচার আগামী ৭ দিনের মধ্যে শুরু হবে। এ ধরনের বক্তব্যে দ্রুত হাততালি উৎপাদন হয় বটে। কিন্তু বাস্তবে সেই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্রই (চার্জশিট) দাখিল হয় ১ মাসের মাথায়। গত ১৩ এপ্রিল এই চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
এমন অবস্থায় কর্তৃপক্ষীয় আশ্বাসে মানুষ ভরসা রাখবে কী করে? কেউ কেউ পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলতেই পারেন যে, আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় তো লাগেই! তাহলে কি উপদেষ্টা না জেনেই এমন মন্তব্য করেছিলেন? নাকি কেবলই লোক দেখানো মন্তব্য ছিল তা? ওই অনেকটা আগেকার সরকারের সময়কার মন্ত্রীদের কিছু একটা বলার জন্যই বলা কথার মতো?
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এ ধরনের উদাহরণ প্রত্যক্ষ করার পর মেনে নিতেই হয় যে, আমাদের দেশে এমন ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে থাকা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই আসলে সমস্যাযুক্ত। এসব সমস্যা একদিনে গড়ে ওঠেনি। পুরোপুরি দূর করতেও সময় লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুরুর চেষ্টা অন্তত থাকা দরকার। অথচ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষীয় জায়গা থেকে কিছু বিবৃতিমূলক কঠোরতা ছাড়া অন্য কিছু সেভাবে মিলছে কি? অন্তত আছিয়ার ঘটনায় তা পাওয়া যায়নি। উল্টো বোধ হচ্ছে, আগের সংস্কৃতিরই যেন পুনরাবৃত্তি চলছে! কেবল খোলসটা নতুন, এই আর কি।
অথচ বর্তমানে নারীর জন্য প্রবল প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে নির্যাতন ও নিপীড়নকারীদের একটি কঠোর বার্তা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই ভাবমূর্তি তৈরিতে সরকার কার্যত ব্যর্থই বলা চলে। এই ব্যর্থতার পাল্লা আরও যত ভারী হবে, ততই বাড়তে থাকবে নারীর প্রতি নিপীড়নের মাত্রা। মনে রাখতে হবে, অপরাধের পরিমাণ কমাতে হলে, অনেক ঘটতে যাওয়া অপরাধ ঠেকাতে হয়। অপরাধীরা তখনই সাবধান হয়ে অপরাধকর্ম থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করে, যখন সে বুঝতে পারে যে, নারীর প্রতি নির্যাতন করলে ‘খবর আছে’! কিন্তু কর্তৃপক্ষের এমন কঠোর ভাবমূর্তিই যে তৈরি হচ্ছে না। আর যাই হোক, খালি মুখের কথায় তো চিড়ে ভেজে না। কিছু কাজও দেখাতে হয়।
আরও পড়ুন:
আমাদের এই বাংলাদেশে নারীদের যতটা বিমানবিকীকরণ করার চেষ্টা দেখা যায়, যতটা খেলো করার প্রচেষ্টা চলে, সেসবের ফিরিস্তি দিতে গেলে লাখ লাখ দিস্তা কাগজের প্রয়োজন হবে। এসবের মধ্য দিয়ে আদতে একটি প্রকট পিতৃতান্ত্রিক চেহারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যেখানে নারীকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয় না আর। যদিও বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নদীমাতৃক হিসেবে। অর্থাৎ, এই দেশে যা কিছু মমতার আধার, কল্যাণকর–তার সবকিছুকেই মায়ের সঙ্গে তুলনীয় করার একটা রেওয়াজ ছিল। ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে, কারণ সেই মাতৃরূপী নারীরাই যে আজ এই দেশে চলাফেরা করেন মেপে মেপে, অসম্মানিত ও হেনস্তার শিকার হওয়ার দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে!
এভাবে পরিমাণের বিচারে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারে না। বাংলাদেশও পারবে না। এই দেশ, সমাজ ও সরকার সেই ‘না পারা’র কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনে নেবে কিনা, তাই এখন দেখার।
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]
অপরাজিতা থেকে পড়ুন: