আমাদের সামনে একটা বিরাট বিপর্যয় আসবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। আর এই বিরাট বিপর্যয় হলো, সম্ভবত আমরা পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি আমেরিকা ও বিশ্বের এক নম্বর উদীয়মান শক্তি চীনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দেখতে পাব। আগামী দশকে এই প্রতিযোগিতা যে আরও তীব্র হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আমি আমার বই ‘হ্যাজ চায়না ওয়ান’-এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি।
আমার আজকের বক্তব্যে আমি আপনাদের কাছে এই মার্কিন-চীন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে চাই। কিন্তু আমি যখন তা করছি, তখন আমি বিশেষ করে আমার এশীয় বন্ধুদের, যারা বিশ্বের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তাদের প্রতি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, আপনারা নিষ্ক্রিয় থাকবেন না, চুপ করে থাকবেন না। কথা বলুন। জোরে ও স্পষ্টভাবে কথা বলুন। আমেরিকা ও চীন এই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার আগে তাদের আরও বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে বলুন। কারণ এটি কেবল আমেরিকান ও চীনাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না, এটি এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। এই কারণেই আমাদের এই দ্বন্দ্বটি বুঝতে হবে। বোঝার পরে, আসুন আমরা কথা বলি। আজ আমার মন্তব্যের লক্ষ্য হলো, এই দ্বন্দ্বের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা। আমি পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছি। প্রথম প্রশ্ন: এই দ্বন্দ্বের কাঠামোগত কারণগুলো কী কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন: এই দ্বন্দ্বে আমেরিকা ও চীন কী ভুল করেছে?
তবে আমার সন্দেহের তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, যেটি সম্পর্কে আপনারা সকলেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। আমেরিকা ও চীনের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্বে কে জিতবে? চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব, এই মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বে অন্যান্য দেশ ও অঞ্চল কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? এবং পরিশেষে, আমরা এ ব্যাপারে কী করতে পারি? আমরা কীভাবে এটি সামলাব? আমি আবারও আমার বক্তব্যটি পুনর্ব্যক্ত করতে যাচ্ছি যে, আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলা উচিত। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাভাবনা করেই কথা বলতে হলে, আমাদের বুঝতে হবে কেন এটি ঘটছে। এটি আসলে আমাকে আমার প্রথম প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। এই মার্কিন-চীন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কাঠামোগত কারণগুলো কী কী?
ন্যূনতম তিনটি কারণ আছে। প্রথমটি হলো–এটি এমন এক দ্বন্দ্ব, যা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। ইতিহাসের প্রাচীনতম কঠোর ভূ-রাজনৈতিক নিয়মগুলোর মধ্যে এটি একটি। যখনই বিশ্বের এক নম্বর উদীয়মান শক্তি বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি ছাড়িয়ে যেতে চায়, তখনই বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি সর্বদা এক নম্বর উদীয়মান শক্তিকে পিছনে ফেলে দিতে চায়। বর্তমান বিশ্বে এক নম্বর উদীয়ময় শক্তি চীন ও পরাশক্তি আমেরিকা। তাই আমেরিকা এখন চীনকে এক নম্বর হওয়া থেকে বিরত রাখার সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
এটি আসলেই হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ভূ-রাজনৈতিক অভিঘাতের ফসল। সুতরাং এটি দেখিয়ে দেয় যে, ভূ-রাজনীতি শুধু ব্যক্তিত্বের বিষয় নয়, এটি মূলত গভীর কাঠামোগত শক্তির ভূমিকা সম্পর্কিত। তাই যখন আমেরিকা চীনকে এক নম্বর হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য উঠেপড়ে লাগে, তখন এটি সেই পুরানো ভূ-রাজনৈতিক অভিঘাতেরই ফল হিসেবেই বিবেচিত হয়। তবে আরও দুটি কাঠামোগত শক্তি রয়েছে। প্রথমটি সম্পর্কে সবাই কথা বলে। দ্বিতীয়টি সম্পর্কে কেউ কথা বলে না। কারণ এটি সম্পর্কে কথা বলা রাজনৈতিকভাবে ভুল।
আর এটাই হলো পশ্চিমা কল্পনায় হলুদ বিপদের (পশ্চিমারা বিশেষত চীনাদের ‘ইয়োলো’ বলে অভিহিত করে) ভয়। আট শ বছর আগে মোঙ্গলরা ইউরোপকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে এই ভয় চলে আসছে। এখন এটি এমন একটি বিষয়, যা পশ্চিমের কেউ কখনো আপনার কাছে বলবে না। তবে এশিয়ার বাসিন্দা হিসেবে আমাদের স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, আবেগসঞ্জাত কারণেই এটি বেশ কার্যকরভাবেই মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। আর চীনের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া কেন হয়েছে তা-ও লুকিয়ে আছে এই হলুদ বিপদে।
আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, এটা সত্য হতে পারে না। নিশ্চয়ই বড় দেশগুলো হলুদ বিপদের ভয়ের মতো স্থূল আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় না। আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, ১৩০ বছর আগে, মার্কিন কংগ্রেসে চাইনিজ রেসিয়াল এক্সক্লুশান অ্যাক্ট নামে একটি আইন পাস করেছিল। এটিই প্রমাণ দেয় যে হলুদ বিপদ বাস্তব এবং আমাদের এটি মোকাবিলা করতে হবে। এই দ্বন্দ্বে তৃতীয় কাঠামোগত শক্তি হলো আমেরিকার কিছুটা অস্বাভাবিক দ্বিদলীয় ঐক্যমত্য যে, চীন তাদের দেশকে হতাশ করেছে।
চীন কীভাবে আমেরিকাকে হতাশ করেছে? অনেক আমেরিকানই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেবে, তখন চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাও উন্মুক্ত হয়ে যাবে। চীন তখন আমেরিকার মতো একটি উদার গণতন্ত্রিক দেশে পরিণত হবে। আর দুটি উদার গণতন্ত্র–চীন ও আমেরিকা চিরকাল সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এখন, এটা আপনার কাছে রূপকথার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু এটা রূপকথার গল্প নয়।
আমার এক বন্ধু, কার্ট ক্যাম্পবেল ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আমেরিকা আশা করেছিল চীন তাদের মতোই হবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট চীন খুব শিগগিরই একটি উদার গণতন্ত্রে পরিণত হবে না। যে আমেরিকানরা এতে হতাশ, আমি প্রায়শই যথেষ্ট বিনয়ের সাথে তাদের বলি, কেন এটা হবে না। আমেরিকা একটি তরুণ রাষ্ট্র, যার বয়স ২৫০ বছরেরও কম। আর চীনের সভ্যতা হাজার হাজার বছরের। আমেরিকার জনসংখ্যা চীনের এক‑চতুর্থাংশ। ফলে কীভাবে আমেরিকার মতো একটি তরুণ দেশ বিশ্বাস করতে পারে যে, তারা চারগুণ জনসংখ্যার এবং চার হাজার বছরের সভ্যতাকে পাল্টে দিতে পারবে?
আমেরিকান মনের সম্পূর্ণ অবাস্তব ধারণার এটি একটি উদাহরণ। ঠিক এ কারণেই আমাদের এশীয়দের কথা বলা এবং আমেরিকানদের একটি মৌলিক সত্য জানানো প্রয়োজন। চীন চীনই হবে। চীন তার দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছে ও হবে। আমেরিকার উচিত, চীনকে বদলানোর ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করা। কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, এই কাঠামোগত শক্তিগুলোই এই দ্বন্দ্বকে চালিত করছে। তারা আরও তীব্রতর হয়েছে।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ভুলগুলো কী কী হয়েছে? আমি অবশ্য জোর দিয়ে বলতে চাই যে, এই দ্বন্দ্বে উভয় পক্ষই ভুল করেছে। চীনের ক্ষেত্রে ভুলগুলো খুবই স্পষ্ট। চীন আমেরিকান ব্যবসায়িক সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল এবং সেই বিচ্ছিন্নতা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ছিল। কারণ, ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে যখনই মার্কিন সরকার চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইত, তখনই আমেরিকান ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ই সবসময় বলত, ‘থামো, থামো’। তারা বলত, চীনে আমার সবচেয়ে বড় বাজার নষ্ট করবে না।
কিন্তু আপনারা জানেন যে, ২০২০ সালে ট্রাম্প যখন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন, তখনো আমেরিকান ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ ছিল। তারা স্পষ্টতই এই ভেবে বিরক্ত হয়েছিল যে, তারা চীনে তাদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি হারিয়েছে। কারণ আমেরিকা থেকে চীনা সংস্থাগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। যেখানে সমান সুযোগ ছিল না। এই অভিযোগগুলো পরিচিত। আপনি সাংহাই ও বেইজিংয়ের মার্কিন চেম্বার অব কমার্সের ওয়েবসাইটে এগুলো খুঁজে পেতে পারেন। এটা চীনাদের একটা ভুল।
কিন্তু আমেরিকা যে ভুলটি করেছিল, তা কিছু দিক থেকে আরও মৌলিক। আমেরিকা কোনো কৌশল ঠিক না করেই চীনের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আপনি বিবেচনা করেন, যেখানে আমেরিকায় বিশ্বের সেরা স্ট্রাটেজিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বের সেরা ও পরিচিত কুশলী চিন্তক আছেন, তাঁদের কোনো কৌশল থাকবে না? তা কি হয় কখনো! কিন্তু সেটাই হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে ড. হেনরি কিসিঞ্জার আমাকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। ওই সময় আমার বই ‘হ্যাজ চায়না ওয়ান?’ লেখার জন্য আলাপ করতে তাঁর সাথে একান্তে মধ্যাহ্নভোজ করেছিলাম। আমি আসলে বইটিতে এ কথা লেখার জন্য তাঁর অনুমতি পেয়েছিলাম যে, আমেরিকার কোনো কৌশল বা পরিকল্পনা নেই।
এবার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই। কে জিতবে? আর এখানে একটা সহজ বিষয় যোগ করি। আমার মনে হয়, আমি মূলত এশীয় দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছি। যদি আমি আমেরিকান দর্শকের সাথে কথা বলতাম, তাহলে তাদের একটি সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতাম, আমেরিকা ও চীনের মধ্যে এই প্রতিযোগিতায় কে জিতবে? এ প্রশ্নে তারা আমার দিকে সম্পূর্ণ বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকাত। বলত, অবশ্যই আমেরিকা জিতবে। আমেরিকা গত ১৩০ বছর ধরে প্রতিটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে পরাজিত করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানিকে পরাজিত করেছে, জাপানের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে পরাজিত করেছে এবং যেমন আপনি জানেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে সরাসরি গুলি না ছুড়েই স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিশাল জয় অর্জন করেছে। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র কেবল জয়লাভ করে। তারা হারতে পারে না।
আসলে, আমেরিকানরা হেরে যাওয়ার আশঙ্কা কল্পনাও করতে পারে না। আর এখানে আমরা ও আমি, যারা নিজেকে অনেক দিক থেকে আমেরিকার বন্ধু মনে করি, তাদের সকলের জন্য বিষয়টি একই। আসলে আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের বুঝতে সাহায্য করা উচিত যে, তাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বিবেচনা করা উচিত। কেন এমন হয়? উত্তরটি খুবই জটিল। আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি আপনাকে এটি সম্পর্কে কেবল একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতে পারি। তবে আমি আশা করি, আপনি যখন আমার বইটি হাতে নেবেন, তখন আপনি এটি সম্পর্কে আরও পড়বেন।
আমেরিকানরা হেরে যাওয়ার আশঙ্কা কল্পনাও করতে পারে না কারণ, তারা এটিকে খুব সহজ ও স্পষ্টভাবে আমেরিকার একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্র এবং চীনের একটি কঠোর কমিউনিস্ট পার্টি ব্যবস্থার মধ্যেকার প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখে। আর বলে যে, গণতন্ত্র সর্বদা কমিউনিস্ট পার্টি ব্যবস্থাকে পরাজিত করে। আপনি শীতল যুদ্ধে এটিই দেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে দুর্দান্তভাবে পরাজিত করেছিল। তাহলে এটা আর এমন বড় কথা কী? আরেকটি কমিউনিস্ট পার্টিই তো। অবশ্যই আমেরিকান গণতন্ত্র এটিকে পরাজিত করবে। আসলে কিছুটা হলেও আমি এই যুক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল। যদি এটি আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি গণতন্ত্র এবং চীনের একটি কঠোর কমিউনিস্ট পার্টি ব্যবস্থার মধ্যকার প্রতিযোগিতা হতো, তাহলে হ্যাঁ, গণতন্ত্র জিততে পারত।
যদি আপনি আমেরিকা ও চীন–এই দুই দেশের সমাজের অবস্থা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র আজ কার্যত গণতন্ত্র থেকে একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে (প্লুটোক্রেসি) পরিণত হয়েছে। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কী? না, যেমনটি আপনি জানেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার। আর ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলো ১%-এর, ১%-এর দ্বারা, ১%-এর জন্য সরকার। কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমি এই কথা বলি না। বিখ্যাত মার্কিনি প্রয়াত পল ভালকার আমাকে প্রায়ই এ কথা বলতেন। বলতেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিজ একটি বই লিখেছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, তা বিশদে বলা আছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রধান অর্থনৈতিক ভাষ্যকার মার্টিন উলফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এর প্রমাণ–এই দেশটি একমাত্র প্রধান উন্নত দেশ, যেখানে ৩০ বছরেও নিচের তলার ৫০% মানুষের গড় আয় বাড়েনি।
আরেকজন নোবেল বিজয়ী যেমন বলেছেন, আমেরিকান শ্রমিক শ্রেণি হতাশার সাগরে ডুবে আছে। তাই আমেরিকান গণতন্ত্র গুরুতর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। আর সেই কারণেই যখন আপনি এত অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, তখন চীনের বিরুদ্ধে একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া খুবই বোকামি। কারণ চীন আজ নিজেকে সঠিকভাবে বদলে ফেলেছে। আজকের চীন কার্যত বিশ্বের বৃহত্তম মেধাতন্ত্র। মেধাতন্ত্র কী? মেধাতন্ত্র একটি ব্যবস্থা এবং আমার মনে হয়, অনেক সিঙ্গাপুরবাসী এটি জানেন, যেখানে আপনি সমাজ পরিচালনার জন্য সেরা মেধাবীদের বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এবং এটি সমাজের কর্মক্ষমতার দিক থেকেও প্রমাণিত হয়।
এরপরও চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন সরকার গড়ে তুলেছে–এ নিয়ে যদি আপনার কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে তার প্রমাণ কোভিড ১৯। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোভিড ১৯ চীনে শুরু হয়েছিল। তবুও চীনে এতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার। আর যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ লাখ। যুক্তরাষ্ট্র যদি কোভিড ১৯ মোকাবিলায় চীন সরকারের মতো কার্যকরভাবে কাজ করত, তাহলে সেখানে ৬ লাখের পরিবর্তে এক হাজার মানুষ মারা যেত। মেধাতন্ত্র এটাই করে। এটি জীবন বাঁচায় এবং একটি উচ্চ-কার্যক্ষম অর্থনীতিও গড়ে তোলে, যা সম্ভবত এক নম্বরে পরিণত হবে। তাই স্পষ্টতই চীন যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, তার প্রকৃতিকে অবমূল্যায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশাল ভুল করছে।
আর তাই মার্কিনিদের বন্ধু হিসেবে আমাদের বলা উচিত, ‘আরে, এই প্রতিযোগিতা শুরু করার আগে কেন তোমরা পিছিয়ে যাও না, একটি বিস্তৃত দীর্ঘমেয়াদী কৌশল তৈরি করো না?’ অপেক্ষা কর এবং বিরতি দাও। কারণ, এটি তোমার জন্য ভালো হবে। দুর্ভাগ্যবশত, অন্তত একান্তে, বেশির ভাগ দেশই এটাই বার্তা পাঠাচ্ছে। কারণ, আমার চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরে, অন্যান্য দেশগুলো কীভাবে নির্বাচন করছে–সে ব্যাপারে আমেরিকানরা যদি যথেষ্ট সংবেদনশীল ও মনোযোগী হয়, তাহলে তারা লক্ষ্য করবে যে, এটা শীতল যুদ্ধের মতো নয় যখন এত এত দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে উৎসাহের সাথে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল। ইউরোপীয়রা সমর্থন করেছিল। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধে মিশরের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ, পাকিস্তানের মতো, ইন্দোনেশিয়া মতো দেশও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল।
এর বিপরীতে, আজ আমি এমন কোনো সরকারের কথা ভাবতে পারি না, যারা চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন দ্বন্দ্বে জড়াতে চাইছে, তাকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে একই রকম উৎসাহী। বরং আসিয়ান অঞ্চলে এটি সবচেয়ে সত্য। আমি মনে করি মোটের ওপর ১০টি আসিয়ান দেশ যদি তাদের কাছে একটি সহজ বার্তা দিতে থাকে, বিশেষ করে বর্তমানে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের কাছে যে সহজ বার্তাটি দেবে, তা হলো–আমাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ, আরও জরুরি বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের কোভিড ১৯ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আপনারা কি দয়া করে এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিরতি দিয়ে আমাদের সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার দিকে মনোনিবেশ করতে দেবেন? আমার মনে হয়, এটিই সেই বার্তা, যা আরও বেশিসংখ্যক দেশ পাঠাচ্ছে। তবে আমাদের আরও জোরালোভাবে এ বার্তা তাদের কাছে পাঠাতে হবে। কারণ আমাদের সমস্যা হলো, আমরা খুব ভদ্র এবং আমরা কখনোই সরাসরি কথা বলতে পারি না। কিন্তু সত্যি বলতে, এই প্রতিযোগিতার মুখে আমাদের আরও স্পষ্টভাবে কথা বলা উচিত। আমাদের সকলের উচিত তুলনামূলকভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কথা বলা। ওয়াশিংটন ডিসি ও বেইজিং উভয়কেই আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা। যখন বিশ্বকে কোভিড ১৯ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যখন আমরা আমাদের অর্থনীতিকে আবার চাঙা করার জন্য লড়াই করছি, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যা করা উচিত, তা হলো–নিজেদের দ্বন্দ্বে দাড়ি টানা। আসুন প্রতিযোগিতায় ফিরে যাওয়ার আগে সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার দিকে মনোনিবেশ করি।
(আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য, যা ইউটিউবের সূত্রে সংগৃহীত। কিশোর মাহবুবানি বক্তব্যটি রেখেছেন ইংরেজিতে, যা কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো।)
লেখক: সিঙ্গাপুরের একজন সাবেক কূটনীতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরামর্শদাতা।
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]