রেয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগে কী, সেটা সম্ভবত কাউকে আর নতুন করে বলতে হয় না। আর্সেনালও আর্সেন ওয়েঙ্গারের সময়ে নিয়মিত চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছে, মাঝে কয়েক বছরে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও এখন আবার ইউরোপের কূলীনদের আসরে তারা নিয়মিত। সে কারণেই তথ্যটা একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে যে, চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় যখন রেয়াল মাদ্রিদ নামবে আর্সেনালের মাঠে, সেটি হবে ১৯ বছরে দুই দলের প্রথম সাক্ষাত!
দুই দলই নিজেদের লিগের পয়েন্ট তালিকার দুই নম্বরে, আর্সেনালের চেয়ে অবশ্য রেয়াল মাদ্রিদের লিগ শিরোপার দৌড়ে আরও ভালোভাবে আছে। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগই দুই দলের জন্য শিরোপার পথে অপেক্ষাকৃত বড় সুযোগ। দুই দলের খেলার ধরনও ম্যাচটার আকর্ষণ আরও বাড়াচ্ছে। মিকেল আর্তেতার অধীন আর্সেনাল আক্রমণে একটু বেশিই ছকে বাঁধা, তবে তার আগে রক্ষণ আর মাঝমাঠে যেভাবে জমাট বেঁধে থাকে, সেটি প্রতিপক্ষকে হাঁসফাঁস করানোর মতো। আর কার্লো আনচেলত্তির রেয়াল মাদ্রিদের খেলাই যেন শুরু হয় মাঝমাঠের পর থেকে! রক্ষণ আর মাঝমাঠে মৌসুমের প্রায় ৯ মাস পেরিয়েও এখনো গুছিয়ে উঠতে না পারা মাদ্রিদের আক্রমণ মানে যে এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগোদের ঝলকের কিছু মুগ্ধতা ছড়ানোর মতো মুহূর্ত। আর্সেনালের খেলায় লক্ষ্য রাখতে হয় বল ছাড়া তাদের ‘অর্গানাইজেশনে’র দক্ষতায়, মাদ্রিদের খেলায় বলের দিকে চোখ রাখলেই চলে। মাদ্রিদের যা ঝলক তো বল পায়ে।
তা এমিরেটসে আজ কোন কোন দিকগুলো ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে? কোন দিকগুলোতে চোখ রাখবেন? পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণের সাইট অপটা অ্যানালিস্ট করেছে সে বিশ্লেষণ –
মাঝমাঠ? সে তো মাদ্রিদের গড়ের মাঠ
রেয়াল মাদ্রিদ আরেকবার চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষভাগে এসে পড়েছে বটে, হয়তো আরও দূরও যেতে পারে। তবে সে তো মাদ্রিদ আর চ্যাম্পিয়নস লিগের এক অদ্ভুত সম্পর্কের রসায়নের জোর। এতদূর মাদ্রিদ কীভাবে এল, সে বিশ্লেষণে গেলে হিসেব মেলাতে কষ্টই হয়ে যাবে। এমন মাঝমাঠ নিয়ে দাপট দেখানো যে কঠিন!
এই সপ্তাহে লিগে নিজেদের মাঠে ভালেন্সিয়ার কাছে হেরেছে মাদ্রিদ, তার আগের ম্যাচে কোপা দেল রে-তে রেয়াল সোসিয়েদাদের সঙ্গে ড্র করেছে ৪-৪ গোলে। এই ম্যাচ দুটি মাদ্রিদের মাঝমাঠ নিয়ে প্রশ্নটাকে আরও জোরাল করে দিয়েছে। মাদ্রিদ যে প্রতিপক্ষকে অনেক বেশিই সুযোগ দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেটা হচ্ছে মাঝমাঠের দুর্বলতার কারণেই।
আগে প্রতিপক্ষকে কেমন সুযোগ দিয়ে বেড়াচ্ছে মাদ্রিদ, সেটার পরিসংখ্যান দেখে নিন। এই মৌসুমে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে এর মধ্যেই মাদ্রিদ গোল খেয়েছে ৬১টি, যেখানে গতবার পুরো মৌসুমেই গোল খেয়েছে এর চেয়ে ১১টি কম। সর্বশেষ আট ম্যাচে তারা ক্লিনশিট রাখতে পারেনি, সর্বশেষ ১৭ ম্যাচের ১৪টিতেই প্রতিপক্ষ মাদ্রিদের পোস্টের দিকে শট নিয়েছে অন্তত ১০টি করে। মাদ্রিদ নড়বড়ে।
উল্টোদিকে আর্সেনালের অবস্থা দেখুন। তাদের পোস্টের দিকে প্রতিপক্ষ অন্তত ১০টি শট নিয়েছে - সর্বশেষ ১৭ ম্যাচে এমনটা দেখা গেছে মাত্র ৫ বার। তাদের বিপক্ষে প্রত্যাশিত গোল (এক্স জি অ্যাগেইনস্ট) পুরো মৌসুমে এখন পর্যন্ত ০.৮৮, যা ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগ মিলিয়েই তৃতীয় সর্বনিম্ন। এর চেয়ে এগিয়ে আছে শুধু আজ চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্য ম্যাচে মুখোমুখি দুই দল – বায়ার্ন মিউনিখ (০.৮০) আর ইন্তের মিলান (০.৮৭)।
মাদ্রিদ রক্ষণে এত ভুগছে কেন? কারণ মাদ্রিদের মাঝমাঠে এদিক ঢাকতে গেলে ওদিক ফাঁকা পড়ে যায়। আর মাঝমাঠের এমন গরীবের কাঁথার মতো অবস্থা কেন? তার পেছনে দায়টা মাদ্রিদের তারকায় ঠাসা আক্রমণভাগের। এই মৌসুমে কিলিয়ান এমবাপ্পে যোগ দেওয়ার পর আক্রমণে ভিনিসিয়ুস, এমবাপ্পে, রদ্রিগো, বেলিংহামদের সবাইকেই খেলানোর লোভ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে আনচেলত্তির জন্য। এমন চার ফরোয়ার্ড পেলে কোন কোচ এঁদের কাউকে বসিয়ে রাখতে চাইবেন? আনচেলত্তি এই ফরোয়ার্ড লাইন খেলাতে ৪-৪-২ ছকেই যাচ্ছেন। সেখানে বেলিংহাম আর রদ্রিগো তারকাখ্যাতি কিছুটা বিসর্জন দিয়ে দলের প্রয়োজনে তবু দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু এমবাপ্পে আর ভিনিসিয়ুসকে নিয়েই যত ঝামেলা।
একদিকে এমন প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন, অবিশ্বাস্য স্কিলসম্পন্ন খেলোয়াড়কে পাল্টা আক্রমণের জন্য ‘ফ্রি’ রাখতে চাওয়ার লোভ থাকে, সেটা করতে গেলে তাঁদের ওপর প্রেসিংয়ের দায়িত্ব অত বেশি দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রেসিং তাঁরা দুজনই কিছুটা ঢিলেঢালাভাবে করলে মাঝমাঠের ওপর চাপটা বেড়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। প্রতিপক্ষের মাঝমাঠ থেকে একজন একটু নিচে নেমে এলেই তাদের ডিফেন্ডাররা এমবাপ্পে-ভিনিকে ফাঁকি দিয়ে সহজে মাঝমাঠে পাস বাড়িয়ে দিতে পারছেন। এমবাপ্পে-ভিনি ‘বাইপাস’ হয়ে যাওয়ায় এরপর তো হিসেবটা সংখ্যারও – প্রতিপক্ষের ৮ জনের বিপরীতে মাদ্রিদের ৮ জন! সাধারণত যেখানে মাদ্রিদের অন্তত ৯ জন থাকার কথা।
মাদ্রিদের বিপক্ষে দলগুলো সে কারণে বলের দখল রাখতে পারছে সহজেই। অপটা অ্যানালিস্ট জানাচ্ছে, লিগে মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ দলগুলো একেকবার বল হারানোর আগে গড়ে ১০.৩ সেকেন্ড বলটা নিজেদের দখলে রাখে, যা লা লিগায়ই পঞ্চম সর্বোচ্চ।
মাদ্রিদের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা - আজকের ম্যাচে নিষেধাজ্ঞার কারণে মিডফিল্ডে অরেলিয়াঁ চুয়ামেনিকেও পাচ্ছে না তারা। তার মানে এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার পাশে লুকা মদরিচের খেলার সম্ভাবনা বেশি। ৩৯ বছর বয়সী মদরিচকে প্রেসিং করতে হওয়ার চাপ দিয়ে নামানো রীতিমতো জুলুম। ফেদেরিকো ভালভের্দে, কামাভিঙ্গা, মদরিচ, বেলিংহামকে খেলাতে গেলে আবার আক্রমণে রদ্রিগোকে বসিয়ে রাখতে হবে। আনচেলত্তি কী করবেন, সেই সিদ্ধান্তই হয়তো ম্যাচের গতিপথ ঠিক করে দেবে।
এমবাপ্পে, আর্সেনাল দলটা কিন্তু ইংলিশ!
রেয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়ে এই মৌসুমে এরই মধ্যে ৩৩ গোল করে ফেলেছেন, যা তাঁর আদর্শ ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর রেয়াল মাদ্রিদে প্রথম মৌসুমে গোলের রেকর্ড। এমবাপ্পে মাদ্রিদে এখনো ঝলক দেখাতে পারেননি, সে বিতর্কটা বড় ম্যাচে তাঁর প্রভাবের বিশ্লেষণে হয়তো এখনো প্রাসঙ্গিক, তবে গোলের হারের দিক থেকে মোটেও নয়। আর আজকের ম্যাচের আগে এমবাপ্পের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য এটিই যে, আর্সেনাল একটা ইংলিশ ক্লাব।
এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্বে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচটাতে এমবাপ্পেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বটে, তবে শেষ ষোলোর দুই লেগে ম্যানচেস্টার সিটিকে শেষ করে দিয়েছেন এমবাপ্পেই। প্রথম লেগে এক গোল, দ্বিতীয় লেগে হ্যাটট্রিক। চ্যাম্পিয়নস লিগে ইংলিশ ক্লাবের বিপক্ষে এমবাপ্পের রেকর্ডও ভালোই – ১৬ ম্যাচে ১০ গোল।
পায়ের খেলায় কথা বলবে হাতের গ্লাভসও
থিবো কোর্তোয়া যদিও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফিট, তবে তাঁকে রেয়াল মাদ্রিদ শতভাগ ফিট হিসেবে পাবে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে। কোর্তোয়া খেলতে পারলে ম্যাচটা দুই দিকে এই মৌসুমের ইউরোপের সেরা পাঁচ গোলকিপারের মধ্যে দুজনের লড়াই-ই দেখবে।
আত্মঘাতী গোলের হিসাব বাদ দিয়ে ধরলে, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের শটের মানের বিবেচনায় যত গোল হওয়া প্রত্যাশিত ছিল (এক্স জি অন টার্গেট), সেটার মধ্যে যত গোল একজন গোলকিপার ফিরিয়েছেন – চ্যাম্পিয়নস লিগে এই মৌসুমে সেই ‘গোল ঠেকানো’র হিসেবে ইউরোপের সেরা পাঁচ গোলকিপারের দুজন আর্সেনালের দাভিদ রায়া আর মাদ্রিদের কোর্তোয়া। রায়া গোল ঠেকিয়েছেন ৩.৮টি, কোর্তোয়া ৩.৯টি। হিসেবটা কীভাবে? কোর্তোয়ার হিসেবটাই দেখুন। অপটা অ্যানালিস্ট জানাচ্ছে, কোর্তোয়ার পোস্টের দিকে যে মানের শট হয়েছে, তার এক্সজি ছিল ১৬.৯। কোর্তোয়া পোস্টে থাকা অবস্থায় (আত্মঘাতী গোল বাদ দিয়ে) রেয়াল মাদ্রিদ গোল খেয়েছে ১৩টি।
তবে ক্লিন শিটের হিসেবে আর্সেনালের রায়া এগিয়ে। তিনি এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে ৫ ম্যাচে গোলপোস্ট অক্ষত রেখেছেন, কোর্তোয়া রাখতে পেরেছেন মাত্র ১বার।
মাদ্রিদকে ‘কর্নারে’ ফেলে দেবে আর্সেনাল?
কর্নারে বলটা ভাসিয়ে দিতে বুকায়ো সাকার জুড়ি নেই। কর্নারে ভেসে আসা বলে সবার আগে মাথা ছুঁইয়ে (ফার্স্ট কনট্যাক্ট) গোল করায় দারুণ দক্ষ গাব্রিয়েল মাগালিয়েস। আর্সেনালের দুর্ভাগ্য বটে, গত সপ্তাহে যে ম্যাচ দিয়ে লম্বা চোট কাটিয়ে সাকা মাঠে ফিরেছেন, ফুলহ্যামের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই চোটে পড়ে মাঠ ছেড়েছেন মাগালিয়েস।
আর্সেনাল যে এই মৌসুমে ইউরোপের অলিখিত ‘কর্নার কিং’, সেটার কারণ তো এ দুজনের যুগলবন্দীই। ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগে ফার্স্ট কনট্যাক্টে গোলের হিসেবে মাগালিয়েসের (৩) চেয়ে এগিয়ে কেউ নেই। গোলের হিসাব ছাড়াও, কর্নারে সবার আগে বলে মাথা ছোঁয়ানোতেও (১৭) মাগালিয়েসের চেয়ে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগে এগিয়ে শুধু ৪ জন।
আর্সেনাল যে লিগে ১১টা গোল করেছে কর্নার থেকে, তার একটা বড় কারণ মাগালিয়েসের উপস্থিতিই। তিনি না থাকায় আর্সেনালের ঝামেলাই হচ্ছে, কর্নারে হেড করার দায়িত্বটা মিকেল মেরিনো আর ইউরিয়েন তিম্বারের ওপরই বেশি পড়বে। তবে সাকা ফেরায় ডান দিক থেকে ইনসুইঙ্গিং কর্নার নেওয়ার ক্ষেত্রে আর্সেনালের চিন্তা কিছুটা কমেছে। সাকা কর্নার নেওয়ায় কতটা দক্ষ, সেটার প্রমাণ এই যে, কর্নারে নেওয়া ক্রসেই শেষ পর্যন্ত গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন, এমন রেকর্ডে সাকার (৩) চেয়ে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগে এগিয়ে আর কেউ নেই। সে তো গেল সাকার কর্নারে সরাসরি প্রথম স্পর্শেই গোলের হিসাব। এর বাইরে কর্নারের পর একাধিক স্পর্শে গোল মিলিয়ে হিসাব করলে, সাকার নেওয়া কর্নার থেকে আর্সেনাল গোল পেয়েছে ৫টি। উল্টো দিকে কর্নার নেওয়ার জন্য ডেক্লান রাইসও আছেন।
রেয়াল মাদ্রিদও অবশ্য কর্নারে গোল করা আর খাওয়ায় অনেকটা সমানে সমান। লিগে ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচ এবং এর আগে কোপা দেল রে-তে রেয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে ম্যাচে মাদ্রিদ কর্নার থেকে গোল করেছে ৩টি, খেয়েছে ২টি।
রদ্রিগো আরেকবার?
ভিনি, এমবাপ্পে, বেলিংহামরা আছেন, তবে রেয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে রদ্রিগোর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দুই পায়ে দক্ষতা, অল্প জায়গায় শরীরের নাচন বা পায়ের ঝলকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, আর গোলের সামনে শিকারী মনোভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো মঞ্চে রদ্রিগোকে মাদ্রিদের বড় অস্ত্র বানিয়ে রেখেছে। রদ্রিগো কী, আর্সেনাল সেটা ম্যানচেস্টার সিটির কাছ থেকে জেনে নিতে পারে।