কথায় কথায় অনেকেই বলে, ‘আমি গরিব মানুষ’। সমস্যা হলো, সেই কথা আবার সকলে বিশ্বাস করে না। বন্ধুবান্ধব তো আরও করে না। কেউ মনে করে ফাঁপর নিচ্ছে, কেউ আবার মনে করে খরচ এড়ানোর জন্য ধান্দাবাজি। এর বাইরে অনেকে সত্যি সত্যিই গরিব থাকে। আর তাদের জন্যই এবার এল নতুন রম্য টিপস!
এবার শেখা হবে ‘ভেরিফায়েড গরিব’ হওয়ার নানা কলা‑কৌশল। নানা বলতে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে উপায়গুলোকে। কিছু একেবারে কঠিন পথ। এই দুনিয়ায় কোনো কিছুই আসলে সহজে পাওয়া যায় না। নিজেকে গরিব প্রমাণ করাটাও তেমনি কঠিন। ধরা যাক, আপনি আসলেই গরিব। কিন্তু আশপাশের কাউকে সেটি বোঝাতে পারবেন না। কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থেই আপনার গরিব হওয়াটা মেনে নিতে চাইবে না। তাই ঢের কসরতের প্রয়োজন আছে কিন্তু।
আবার কারও কারও এত ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ পার হওয়ার এনার্জি থাকে না। তারা চায় একটু সহজে নিজেকে গরিব হিসেবে প্রমাণ করতে। তাই তাদের জন্য আছে মধ্যপন্থা। আর এর বাইরে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা একেবারেই অলস প্রকৃতির। এরা চায় অতি সহজে লক্ষ্য অর্জন করতে। এরা এতটাই অলস যে উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক দল খুলে তার চেয়ারম্যান হয়েও একপর্যায়ে রোদে‑জলে রাস্তায় নামতে হবে বলে দলের নামই ভুলে যেতে চায়! এ ধরনের মানুষের জন্য আছে একেবারে সহজপন্থা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ভেরিফায়েড গরিব হলে লাভ কী? এমন প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়। লাভ‑ক্ষতি তো বুঝে নিতেই হবে। লাভ না হলে কোনো কাজ করারও মানে নেই। ভেরিফায়েড গরিব হওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মী বা আত্মীয়স্বজনের আড্ডায় গেলেও আপনাকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না! বরং আড্ডাস্থল থেকে ফেরার সময় কেউ কেউ লিফটও দিতে পারে, পেতে পারেন বাসভাড়াও!
এর বাইরেও নানা ধরনের বাড়তি খরচ বেঁচে যেতে পারে। ফুটানি দেখানোর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। পকেটে ফুটো পয়সা না থাকলেও আমরা অনেকেই ফুটানি দেখাই, অনেকে দেখাতে বাধ্যও হই। কারণ ফুটানি না দেখালে কেউ যে পাত্তা দিতে চায় না! এভাবে অনেক বাড়তি টাকাপয়সা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু ভেরিফায়েড গরিব হতে পারলে সেই সংক্রান্ত খরচ বেঁচে গিয়ে খুলে যেতে পারে সঞ্চয়ের পথ। দেখা গেল, ব্যাংকে ডিপিএস খুলে ফেলতে পারলেন সেই টাকায়। আর ডিপিএস না খুলতে পারলেও মাটির ব্যাংক কিনে পয়সা জমাতে তো পারবেনই।
এমন আরও নানা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে ভেরিফায়েড গরিব হয়ে। প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন‑সংগ্রাম করে টিসিবি’র লাইনে বাড়তি সুবিধাও আদায় করে নেওয়া যেতে পারে। আর একবার আন্দোলন শুরু করে দিলে এমন কত সুবিধা নেওয়ার কথা মাথায় আসবে। কোনোভাবে রাজনৈতিক দল খুলে ফেলতে পারলে, তো কথাই নেই! দলের নাম হতে পারে, ‘বাংলাদেশ গরিব পার্টি (বাগপা)’। স্লোগান হবে, ‘বাংলার চিহ্নিত গরিবেরা এক হও’। লড়াই করার কথা অবশ্য বলতে হবে না, গরিবেরা এমনিতেই লড়াই করে কিনা!
যাক, অনেক আগডুম, বাগডুম কথা হয়েছে। এবার আসল আলোচনায় ঢোকা যাক। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, ভেরিফায়েড গরিব হওয়ার কিছু উপায়।
চরমপন্থা: প্রথমেই আসে চরমপন্থা। এটা আসলে কঠিন একটি পথ। বাংলা সিনেমার নায়কদের চিরাচরিত সংলাপ অনুযায়ী বলতে হয়–এই পথে পায়ে পায়ে মৃত্যুর খেলা! তাই এক্ষেত্রে কষ্ট একটু বেশিই করতে হবে। মনে ও মননে পুরোপুরি গরিব হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একইসঙ্গে পোশাক ও আচরণেও গরিবানা অবস্থা ফুটিয়ে তুলতে হবে। দিনে ও রাতে অন্তত ৫০ বার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে প্রকাশ্যে বলতে হবে, ‘আমি গরিব মানুষ’। আর রাতে ঘুমানোর আগে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠেই ২৫ বার করে মোট ৫০ বার নিজেকে শোনাতে হবে যে, ‘আমি গরিব’। এই ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে উঠেই ‘আমি গরিব’ বলাটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেই যখন বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে আপনি গরিব, তখন পুরো বিষয়টা সহজ হয়ে আসবে। এভাবে আগে নিজে বোঝার পর অন্যকে বোঝাতে হবে।
আর পোশাকের ক্ষেত্রে অবশ্যই চাকচিক্য এড়িয়ে চলতে হবে। এর জন্য পয়সা খরচ করে ফুটোফাটা জামা‑কাপড়ও কেনা যেতে পারে। এমনভাবে চলতে হবে যেন আপনাকে দেখেই এক ধরনের মলিন ‘ভাবমূর্তি’ ফুটে ওঠে। তবে হ্যাঁ, যখন একা থাকবেন, তখন এতকিছু মেনে চলার দরকার নেই। কিন্তু আশপাশে অন্য মানুষ দেখলেই আবার ‘গরিব’ মোডে চলে যেতে হবে। এভাবে মাস ছয়েক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে পারলেই আশা করা যায় আপনার পরিচিতরাই আপনাকে গরিব হিসেবে মেনে নেবে এবং স্বেচ্ছায় ভেরিফিকেশন ব্যাজ বানিয়ে এনে একেবারে কপালে লাগিয়ে দেবে!
মধ্যপন্থা: এটি একেবারে কঠিন পথও নয়, আবার একেবারে সহজও নয়। এই পথে ডোজ কিছুটা কম। যেমন: দিনে ও রাতে অন্তত ২৫ বার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে প্রকাশ্যে বলতে হবে, ‘আমি গরিব মানুষ’। চরমপন্থায় এটা ন্যূনতম ৫০ বার প্রয়োজন হতো। আর রাতে ঘুমানোর আগে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাড়ে বারো বার করে মোট ২৫ বার নিজেকে শোনাতে হবে যে, ‘আমি গরিব’। প্রশ্ন জাগতেই পারে যে সাড়ে বারোবার কীভাবে হবে? আসলে এক্ষেত্রে একটু চালাক আপনাদের হতেই হবে। ১২ বার ‘আমি গরিব’ নিজেকে শোনানোর পর শেষের বার শুধু ‘আমি…’ বলেই একটু আবেগাক্রান্ত হওয়ার অভ্যাস চালাতে হবে। এটাও কিন্তু কাজে লাগবে কখনো না কখনো। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে অভিনয় কখনো বৃথা যায় না! তা যতোই ‘পিও’ ডেকে নাটক কম করতে বলা হোক না কেন। কারণ নাটক করতে যে আমরা বড্ড ভালোবাসি!
অন্যদিকে পোশাকে ও আচরণে গরিবানা ভাব আনতে হবে পরিমাণ অনুযায়ী। যেহেতু একেবারে কঠিন পথে হাঁটতে পারছেন না, সুতরাং কম্প্রোমাইজ তো করতেই হবে। সেই কম্প্রোমাইজটা হবে আসলে ভেরিফায়েড গরিব হওয়ার ক্ষেত্রে। সময় খানিকটা বেশিই লাগবে। বছরখানেকও লেগে যেতে পারে। কারণ ডোজ যেহেতু কম, রেজাল্টও আসবে ধীর লয়ে। এবং ভেরিফিকেশন ব্যাজও নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে।
এক্ষেত্রে একটি কাজ প্রভাবক হিসেবে কাজে দিতে পারে। এই কাজে কিন্তু বাড়তি চেষ্টাও করতে হবে। কাজটি হলো পরিচিতমণ্ডলে গণহারে ধার চাওয়া। এতে করে সবাই আপনাকে কিছুটা হলেও দ্রুতগতিতে ‘গরিব’ হিসেবে মেনে নিতে পারে। তবে সমস্যা হলো ‘ধার চাওয়া’র মাত্রা যদি পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিমিত না হলে, সবাই আপনাকে বয়কটও করে দিতে পারে। বলে রাখা ভালো, এই পন্থায় ‘ছ্যাঁচরা গরিব’‑এর মেডেল পাওয়ার আশঙ্কা থাকে!
সহজপন্থা: এটি একেবারেই সহজ উপায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের জন্য আদর্শও বটে। এর জন্য দিনে ও রাতে অন্তত ২৫ বার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে প্রকাশ্যে বলতে হবে, ‘আমি গরিব মানুষ’। এর বেশি প্রয়োজন নেই আসলে। নিজেকে বোঝানোরও দরকার নেই। বাকি নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রেও শিথিলতা আছে।
তবে এই পথে খরচা আছে। কী কী, ভুরু কোঁচকাচ্ছেন কেন? এহ্, মামার বাড়ির আবদার! সহজে ভেরিফায়েড গরিবও হতে চান, আবার খরচ করতেও বাধে, এত ছোটলোক হলে তো হবে না।
যাক, প্রক্রিয়াটি বলে ফেলি। প্রথমে নিজের নাম এফিডেভিট করে বদলে ফেলতে হবে। বাপ‑মায়ের দেওয়া নামের আগে বসিয়ে দিতে হবে ‘গরিব’। এরপর নিজের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়্যাটসঅ্যাপ–সবকিছুর প্রোফাইলের নাম বদলে ওটিই দিতে হবে। এরপর মেটা ভেরিফায়েডের সাবস্ক্রিপশন কিনে নিয়ে সেই প্রোফাইলটিকে ভেরিফায়েড করে ফেলতে হবে। আর সেই ব্লু টিক আপনার ‘গরিব’ দিয়ে শুরু নামের পরে বসামাত্রই আপনি হয়ে যাবেন ‘ভেরিফায়েড গরিব’!
অনেক বকবক হয়েছে। আর না। এবার যে যার উপযোগী প্ল্যান বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিন। ভবিষ্যতের ভেরিফায়েড গরিবদের জন্য রইল অগ্রিম শুভ কামনা।