নানা সমীকরণ মিলিয়ে অবশেষে দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বসতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আগামী ২০ জানুয়ারি বুঝে নেবেন দায়িত্ব। এরই মধ্যে তাঁর আগামী প্রশাসনে কারা থাকছেন, ঘোষণা দিয়েছেন সেসব নামও। একবার প্রেসিডেন্ট হয়ে, পরেরবার ভোটে হার; এরপর ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে ভোটের মাঠে জয়ী হওয়া–এভাবে ট্রাম্পের ফেরাটা মোটেও সহজ কিছু ছিল না। এই ফেরা যেমন বিস্ময়ের, তেমনি কারও জন্য আশার, আর কারও উৎকণ্ঠার। সব মিলয়ে ট্রাম্পের এই ফেরায় বিশ্ববাসীর সামনে আশা বা নিরাশা ঠিক কী, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথমবার জয়ী হয়েছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন তাঁর বিজয়কে অবশ্য অপ্রত্যাশিত সাফল্য হিসেবে অভিহিত করার সুযোগ ছিল। এর পরেরবার ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের কাছ পরাজিত হন তিনি। ওই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন এই রাজনৈতিক নেতা। তাঁর সমর্থকেরা করেন ব্যাপক হাঙ্গামা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যেমের তথ্যানুযায়ী, ট্রাম্পের উসকানিতে তাঁর উগ্র সমর্থকেরা ভোটের পর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে (ক্যাপিটল হিল) রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছিলেন। এ নিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা হয়। এমনকি একটি ফৌজদারি মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত পর্যন্ত হন।
এত কিছুর পরও ট্রাম্প যে আবারও ভোটে লড়বেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ঘোষণা দেন ২০১৯ সালের জুনের মাঝামাঝি এসে। ২০২০ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানান তিনি। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ে ফের বিজয়ী হন ট্রাম্প। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন তিনি। প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, ট্রাম্প পেয়েছেন ২৭৭টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৪টি।
হোয়াইট হাউস ছাড়ার চার বছর পর আবারও সেই কার্যালয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরতে যাচ্ছেন নানা ইস্যুতে আলোচিত ট্রাম্প। ৭ কোটি ১০ লাখের বেশি মার্কিনের ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনী প্রচারণার পর্বকে ইতিহাসের অংশ বললে কম বলা হবে না। প্রচারের সময় ট্রাম্পকে দুই দফা হত্যাচেষ্টা হয়। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেই অঙ্গরাজ্যগুলোতে হয়েছে, সেসব অঙ্গরাজ্যে আমেরিকানরা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পেছনে অর্থনীতি ও অভিবাসনের মতো ইস্যুগুলোকে সামনে রেখেছেন।
শারীরিক অসুস্থতাসহ নানা কারণেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আবারও প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছিলেন না তাঁর সমর্থকেরা। তবে, বাইডেন ছিলেন অনড়। বলেছিলেন, তিনিই লড়বেন। শেষ মুহূর্তে এসে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বাইডেন। গত ২১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি।
আগের নির্বাচনে, ২০২০ সালে, জো বাইডেনের কাছে হারলেও ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন ট্রাম্প। নির্বাচনে হারার পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার জন্য সেবার তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেসব কার্যক্রমের সমালোচনা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে এবারের নির্বাচনে সে পথে হাঁটতে হয়নি তাঁকে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক মন্দা বা মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বাইডেন প্রশাসন দায়ী বলে মনে করেন ভোটারদের একটা বড় অংশ। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে রেকর্ড মাত্রার অবৈধ অভিবাসন নিয়েও ভোটারদের একটা বড় অংশকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে দেখা যায়। ট্রাম্প বা তাঁর সমর্থকদের মতো এই ভোটারদের অনেকেই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পক্ষপাতী। এরই প্রভাব পড়ে ভোটের মাঠে।
এবারের নির্বচানী প্রচারে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসলে মার্কিন নীতির কতটা পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে এখনও সন্দেহ রয়েছে অনেকের মধ্যে।
২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় বসেন, তখন রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বহিরাগতই ছিলেন। সে সময় শুরুতে একটা সময় পর্যন্ত তিনি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ নিয়েছেন। তবে এই দফায় তিনি খুব একটা নিয়মমাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান বলে মনে হয় না। তাঁর আসন্ন প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে নানা আলোচনা আছে।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের সামনে আমেরিকার দুটি দিক তুলে ধরা হয়েছিল ট্রাম্পের পক্ষে। তিনি ভোটারদের বলেছিলেন, তাদের দেশ ক্রমাগত ধ্বংসের পথে যাচ্ছে এবং শুধু তিনি দেশকে ‘আবারও মহান দেশে পরিণত’ করতে পারবেন। অন্যদিকে, কমলা হ্যারিস সতর্ক করেছিলেন, যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হন, তাহলে আমেরিকার গণতন্ত্রই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
প্রতিবেদন বলছে, প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। এবার দ্বিতীয় দফায় তাঁর প্রস্তাবিত অনেক পরিকল্পনাই হয়তো বাস্তবে রূপ দিতে চাইবেন তিনি। মনে রাখতে হবে, শুধু যে আমেরিকানরাই ট্রাম্পকে দ্বিতীয় দফায় মোকাবিলা করতে যাচ্ছে, তা নয়। বাকি বিশ্বও দেখতে পাবে যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলতে তিনি আসলে কী বোঝান। এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ, সিরিয়া, গাজাসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও অস্থিরতা, এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ায় ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এসব আলোচনার কতটা বাস্তবে রূপ নেয়, তা অবশ্য বলার সময় এখনো আসেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিতে ২০% শুল্ক আরোপের প্রস্তাব, ইউক্রেন আর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিসহ ট্রাম্পের দাবি করা বিভিন্ন নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সেগুলো এখন দেখার বিষয়। সবমিলিয়ে ট্রাম্পের হাতে আমেরিকার গন্তব্য কোন পথে তা বলে দেবে সময়ই। আর এককেন্দ্রিক বৈশ্বিক কাঠামোয় মার্কিন গন্তব্য এবং সে লক্ষ্যে তার নীতি অনেকাংশেই বিশ্বের ভাগ্যলিপি লিখে দেয়, তা কে না জানে।