কুমিল্লার বন্যায় হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। ঘরবাড়ি হারানো হাজারো শিক্ষার্থী হারিয়েছে বই খাতাসহ স্কুল–কলেজের পোশাক। চোখের সামনে সব হারিয়ে মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ শিশু শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমি পর্যায়ের চার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবকাঠামোগত ক্ষতির মুখে পড়ে সহসায় চালু করা যাচ্ছে না।
বুড়িচং উপজেলার নানুয়ার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা জিম। ঘর-বাড়ি ভেসে গেছে বন্যায়। বানের পানি নেমে গেছে বিধ্বস্ত বাড়িতে খুঁজে পাওয়া গেল তার স্কুল ব্যাগ। কিন্তু টানা ১২ দিন বন্যার পানিতে ডুবে থেকে নষ্ট হয়ে জিমের তিন বোনের সব বই খাতা। ব্যাগ ও স্কুলের পোশাক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দুর্যোগে বাবা–মায়ের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেরই শিক্ষাজীবন বন্ধের পথে।
নানুয়ার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা বলে, ‘আমাদের দুই বোনের বই খাতাসহ আমার সব বই খাতা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন স্কুল খুললে, যেতে পারব না।’
সদর উপজেলার বদরপুর গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র অনিক চন্দ্র দাস। বন্যায় তার ঘরে থাকা সব বই খাতা ভিজে গেছে। বাড়ির সামনে স্পিডবুটে সেই বইটা শুকোতে দিয়েছে তার বাবা-মা। কিন্তু উল্টাপাল্টা দেখা গেল এসব বই খাতা আর ব্যবহার করা যাবে না। অনিকের সঙ্গে অনিকের বোন জয়ার বই খাতা ও নষ্ট হয়ে গেছে।
অনিক চায় তার স্কুল খুব তাড়াতাড়ি শুরু হোক। আবার বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা ও খেলাধুলা হবে। সে জানায়, হঠাৎ করে এখন স্কুল খুললে বই খাতা পাওয়া যাবে না। তার বাবাকে স্কুলে গিয়ে নতুন বইয়ের জন্য কথা বলতে হবে। না হয় স্কুলে গিয়েও কোনো লাভ নেই।
বন্যায় ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণে সহসা অনেক প্রতিষ্ঠান সচল না হবার কারণেও স্কুল–কলেজ বিমুখ হতে পারেন অনেকেই।
বুড়িচং উপজেলার খাড়াদাতাইয়া মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মিনুয়ারা আক্তার বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারই বন্যার কারণে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টকর। শিক্ষার্থী মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে। তাদের আবার স্কুলমুখী করতে হলে শিক্ষকদের পারিবারিক ঘুরে গিয়ে উৎসাহী করতে হবে।’
একই উপজেলার সোনার বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ বলেন, ‘নিজের চোখের সামনে বাড়িঘর ভেঙে যেতে দেখে শিশু শিক্ষার্থীরা এক ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। তাদের সবার সহযোগিতার মাধ্যমে আবার স্কুলে ফেরাতে হবে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য মতে, সাম্প্রতিক বন্যায় ১০৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ ২০৫টি এবং ১২৩টি মাদ্রাসার বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান খুব শিগগরিই চালু করা যাচ্ছে না। তবে শিক্ষার্থীরা যেন স্কুল–কলেজে ফিরতে পারেন সেজন্য সরকারি সর্বোচ্চ সহযোগিতার কথা জানালেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
কুমিল্লা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যাদের বইখাতা ও স্কুল-কলেজের পোশাক হারিয়েছে আমরা তাদের সহযোগিতা করব। যারা খাদ্য সংকটে আছে তাদেরও সাহায্য করা যাবে। অনেক স্কুল–কলেজের সংযোগ সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। এছাড়া একতলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট হয়েছে। সেগুলো ঠিক না করে পাঠদান শুরু করা যাবে না। আমরা এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি - সব এলাকা থেকে পানি নেমে গেলে মোট ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জানা যাবে।’
৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৩২টি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেরামত ছাড়া ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন বানের পানি থাকবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।