শৈশবেই বাবা–মা হারানো এতিম একটা মানুষ। বড় হওয়ার পর সে পথে কুড়িয়ে পায় আরেক এতিমকে, দুধের এক শিশু। তারও মা–বাবা মরে গেছে অকালেই। শুভাকাঙ্ক্ষী জানিয়েছিল ওই এতিমকে হাসপাতালের আউটডোরে ফেলে ঝামেলা থেকে মুক্তির উপায়। কিন্তু তা আর হলো না। নিজের জীবনটা মনে পড়ে যাওয়ায় শিশুটিকে রাখতে হলো কোলেই। এক এতিমই বুঝল আরেক এতিমের কষ্ট!
পূর্ণ বয়সের এতিমই আসলে ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’। ঈদ উপলক্ষে হইচই মুক্তি দিয়েছে এই সিরিজ। নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী। এই একটি নামই ৭ পর্বের ওয়েব সিরিজটি দেখতে আগ্রহী করে তোলার জন্য যথেষ্ট। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে মোশাররফ করিমের নাম। ফলে ঈদের আয়োজন হিসেবে ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ যে দারুণভাবে উপযুক্ত, তা বলাই যায়।
স্বাভাবিকভাবেই ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’টি হয়েছেন মোশাররফ করিম। সিরিজের গল্প সম্পর্কে হইচই বলছে, এটি আব্বাস নামের এক অনাথ ট্রাকচালকের গল্প। যার যাযাবর পেশা তাকে বাংলাদেশের ৮টি ভিন্ন শহরে ৮টি আলাদা জীবন গড়ে তোলার সুযোগ দেয়। প্রতিটি শহরে একেকজন স্ত্রী, যারা প্রত্যেকেই মনে করেন, তারাই একমাত্র। ট্রাক ড্রাইভার আব্বাস মূলত নানা জেলায় নানা পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়েগুলো করেছে। একেক স্ত্রীর জীবনে আব্বাস একেক রকম। আব্বাসের ট্রাকের হেল্পার সেলিম আবার সব গোপন খবরই জানে! ঘটনাচক্রে ৮ নম্বর বিয়ে করার পরই আব্বাসের জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। আর সেখান থেকেই মূলত সিরিজের শুরু।
প্রথম পর্বের একেবারে শুরুতেই আব্বাসের ৮ নম্বর বিয়ের বিষয়টি চলে আসে। কমেডি ড্রামা হিসেবে সিরিজের শুরু থেকেই হাস্যরসাত্মক কিছু দৃশ্যেরও অবতারণা করা হয়। ৮ নম্বর বিয়ে হয় এবং সমস্যারও শুরু দেখা যায়। একেকটি পর্বে আব্বাসের একেক স্ত্রীর পরিচয় উঠে আসে ধীরে ধীরে।
শুরুর দুটি পর্বে গল্পের তাল মেলাতে কিছুটা সমস্যা হয়। উদ্দেশ্য–বিধেয়ও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কমিক ফিলিং আনার জন্য যেসব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়, তার অন্তত ৫০ শতাংশে কৌতুকবোধ তেমন তীব্রও ছিল না। তবে তিন নম্বর পর্ব থেকে ধীরে ধীরে গল্পের ভেতরের আরেক গল্পের দেখা মিলতে থাকে। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আবহের পরিবর্তনও চোখে পড়তে থাকে। আব্বাসের গল্পে তখন আর শুধু কমেডির মোড়ক থাকে না। এর সাথে উঠে আসতে থাকে এই দেশ ও সমাজের কিছু নিষ্ঠুর সত্য। আসে মানবিকতা ও সমাজ বাস্তবতার মিশ্রণ।
এটি বলতেই হয় যে, প্রায় ১৭৮ মিনিটের ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ পুরোটা সময় সমান তালে দৌড়াতে পারেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্পের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, কেন জানি ‘বোহেমিয়ানা ঘোড়া’র গল্পকে ঠিক সম্পূর্ণ মনে হয় না। হয়তো ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য প্রচলিত দৈর্ঘ্য মেনে চলতে গিয়ে এই সিরিজের গল্প বলায় একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব নারী চরিত্রকে আব্বাসের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে, তাদের উপস্থিতি ও জীবনের কাহিনী আরেকটু সবিস্তারে বলা যেত। এতে হয়তো এক পর্বের সঙ্গে আরেক পর্বকে যুক্ত করাটাও দর্শকদের জন্য সহজ হতো। আবার দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে দৌড়ে বেড়ানোটাও কেমন যেন প্লেনের গতিতে হয়ে গেছে। পথের দূরত্বের দৈর্ঘ্যকে উপযুক্ত মাপে অনুভব করা যায়নি। অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধনও ঠিক মজবুত নয়।
আব্বাসের স্ত্রীগণ সকলেই সংগ্রামী। জীবনের যুদ্ধে হেরে যেতে যেতে কেউ ঘুরে দাঁড়ায়, কেউ আবার পারে না। সবার ক্ষেত্রেই আব্বাসের ভূমিকা সহযোগীর। এতিম আব্বাস মায়ার খোঁজে ঘোরে পথে–প্রান্তরে, ভুলও করে। বহুবিবাহের কারণ হিসেবে আব্বাসের কামহীন কিছুটা মানবিক মানসিক গঠনটিও কেন জানি সিরিজে ফুটে উঠতে উঠতেও আবার বুজে যায়। একই অবস্থা আব্বাসের স্ত্রীদেরও। অথচ আরেকটু সময় ও সুযোগ দিয়ে এসবের ঘাটতি পূরণ করা যেত গুছিয়ে। তাতে ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’র দৌড় আরও ক্ষীপ্র হতো, তাতে সন্দেহ নেই।
তবে হ্যাঁ, এটি সত্য যে, এই সিরিজের গল্প একেবারেই অনন্য। এমন গল্প নিয়ে বাংলা ওটিটি-তে কাজ খুব একটা হয় না। সেদিক থেকে অমিতাভ রেজা চৌধুরীকে কুর্নিশ করতেই হয়। বাংলার নারীকে যেভাবে নানা রূপে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে, সেটি অভিনব ভঙ্গি। সেই সাথে সংলাপ ও দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে চিরন্তন মানবতাকে তুলে ধরাটাও ছিল দারুণ। কিন্তু গল্পকে পর্দায় পুরোপুরি আনার ক্ষেত্রে যে অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে, তাতে তৃপ্তিটা ঠিক পুরোপুরি হয় না। অনেকটা আচারের মতোই, আরেকটু হলে আরও ভালো হতো বলে বোধ হয়!
আব্বাস চরিত্রে ছিলেন মোশাররফ করিম। সিরিজের মূল খুঁটি এই চরিত্রটিই। এবং এর প্রতি পুরোপুরি সুবিচার করেছেন মোশাররফ করিম। চরিত্রটির শেড ছিল নানামাত্রিক এবং ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল এই চরিত্রটিকে পর্দায় আনার ক্ষেত্রে মোশাররফ করিমের চেয়ে ভালো বিকল্প পাওয়া সত্যিই কঠিন। আব্বাস হিসেবে তাই এই অভিনেতা সফল। অন্যদিকে আব্বাসের ৮ স্ত্রীর ভূমিকায় আছেন রুনা খান, তানজিকা আমিন, মৌসুমী হামিদ, সাদিয়া আয়মান, ফারহানা হামিদ, রোবিনা রেজা জুঁই এবং নতুন দুই মুখ আসমা উল হুসনা বৃষ্টি ও সারাহ জেবিন অদিতি। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। তবে অভাব ছিল স্ক্রিন প্রেজেন্সের দৈর্ঘ্যের। বেশি সুযোগ পেলেও যে তাঁরা দারুণ করতেন, সেটি বলাই যায়। এছাড়া রাকিব হোসেন ইভন, অশোক বেপারি, সুমন পাটোয়ারি ছিলেন সমুজ্জ্বল। এক কথায়, অভিনয়ের দিক থেকে খুঁত বের করা বেশ কঠিনই।
কামরুল হাসান খসরুর সিনেমাটোগ্রাফিতে সিরিজটি দৃষ্টিনন্দন। আর্ট ডিরেকশনের জন্য শহিদুল ইসলামকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। সাউন্ড ডিজাইন ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও উপযুক্ত।
‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’র মূল সম্পদ আসলে এর গল্প ও অভিনয়। থ্রিলার, মিস্ট্রি এড়িয়ে একেবারেই নতুন ঘরানার কাহিনী বলার চেষ্টা হয়েছে সিরিজটিতে। ঈদের ছুটিতে একটু ভিন্ন কিছু দেখতে চাইলে ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’র দিকে তাকানোই যায়। কিছুটা অসম্পূর্ণ বোধ হতে পারে। তবে এই সিরিজ অপরাপর সিরিজ থেকে যে অনেকটাই আলাদা, সেটি নিশ্চিত।