মাথার চুল পড়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ হওয়া, মানসিক অবসাদ- তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ধরণের লক্ষণে ভুগছেন অনেকেই, যার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে হাইপোথাইরয়েডিজম বা শরীরে থাইরয়েড হরমোনের অভাব। আসুন জেনে নিই রোগটি সম্পর্কে।
থাইরয়েড কী?
থাইরয়েড হচ্ছে আমাদের গলার সামনে প্রজাপতির মত ছড়িয়ে থাকা একটি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে যে হরমোন বের হয়, তার নাম থাইরয়েড হরমোন। এই হরমোন মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিপাকীয় শক্তি। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন থাইরয়েড গ্রন্থি কাজ শুরু করে, তা চলমান থাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এবং, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের সকল কোষ এই হরমোনের প্রভাবে প্রভাবিত।
থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে যাবার কারণ কী?
বাংলাদেশে প্রতি ০৫ জনে ০১ জন থাইরয়েডের রোগী। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০-৫০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এ রোগের হার বেশি। এই রোগের প্রধান কারণ সমূহ হচ্ছে:
অটোইমিউন ডিজিজ: বর্তমান সময়ে এই রোগের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- অটোইমিউনিটি। এটি হচ্ছে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং অ্যান্টিবডি তৈরির কারণে থাইরয়েডের কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ফলে হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হওয়া।
আয়োডিনের অভাব: থাইরয়েড হরমোন তৈরির অন্যতম মূল উপাদান হচ্ছে আয়োডিন। বয়স্কদের থাইরয়েডের সমস্যার পিছনে আগে একসময় আয়োডিনের ঘাটতিকে প্রধান মনে করা হতো। কিন্তু, ব্যাপকভাবে লবণে আয়োডিনযুক্ত করার ফলে, কমে এসেছে আয়োডিনের ঘাটতি। তারপরও, দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার কম থাকায় এ সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে- বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
চিকিৎসা পরবর্তী জটিলতা: থাইরয়েড ক্যানসার বা থাইরয়েডে নডিউলের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি বা সার্জারির পর হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ: মৌসুমি পরিবর্তনের সময় সর্দিকাশির সঙ্গে থাইরয়েডের প্রদাহ হতে পারে, যার ফলে কিছুটা সময় শরীরে থাইরয়েড হরমোনের অভাব দেখা দেয়। একইভাবে, গর্ভ–পরবর্তী পরিস্থিতিসহ আরও কিছু কারণে এই ধরনের প্রদাহ দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো ক্ষণস্থায়ী, তবে কিছুক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে রোগী হাইপোথাইরয়েড হয়ে যেতে পারেন।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: লিথিয়াম বা কিছু হার্টের ওষুধ থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে।
জন্মগত কারণ: কিছুক্ষেত্রে কোনো কোনো শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থি তৈরি হয় না বা গ্রন্থি থেকে হরমোন তৈরি হয় না। এ ক্ষেত্রে শিশু মারাত্মক ধরনের থাইরয়েড সমস্যাতে ভুগে।
হাইপোথাইরয়েড-এর লক্ষণ কী?
প্রকৃতপক্ষে শরীরের সকল কোষের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাবের কারণে, এই রোগের লক্ষণ সুনির্দিষ্ট কিছু নয়। রোগটি কতদূর এগিয়েছে তার ওপর নির্ভর করে শরীরে নানা রকম উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দেয়৷ যেমন:
১. মাথার চুল পড়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ হওয়া।
২. মানসিক অবসাদ, তন্দ্রাভাব।
৩. শীত সহ্য করতে না পারা।
৪. ওজন বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য।
৫. অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত মাসিক, বন্ধ্যাত্ব।
৬. হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া, শরীর ফোলা।
৭. রক্তে চর্বির মাত্রা বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তি লোপ।
৮. গলার স্বর বদলে যাওয়া- সহ নানা ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
৯. শিশুদের ক্ষেত্রে- উচ্চতা বৃদ্ধি না পাওয়া, মনোযোগের ঘাটতি, স্কুলে রেজাল্ট খারাপ হওয়া, দ্রুত ১০. ওজন বৃদ্ধি, অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া সহ- নানা লক্ষণ নিয়ে রোগটি প্রকাশ পায়।
রোগ নির্ণয় কীভাবে?
ব্যাপকতা ও সহজলভ্য চিকিৎসার কারণে, থাইরয়েড পরীক্ষা এখন রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত। তাই উপর্যুক্ত লক্ষণ দেখা দিলে, দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড ও ক্ষেত্র বিশেষে স্ক্যান করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া উচিত।
চিকিৎসা পদ্ধতি কী?
অন্যান্য যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের তুলনায় এই রোগের চিকিৎসা তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। হাইপোথাইরয়েডিজমের মূল চিকিৎসা হলো সিনথেটিক থাইরয়েড হরমোন (লেভোথাইরক্সিন) গ্রহণ।
চিকিৎসকের নির্দেশিত মাত্রায় নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে, গলগন্ডের জন্য সার্জারির মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। তবে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি:
ওষুধের সময়সূচি: সকালে খালি পেটে ওষুধ খাওয়া ভালো। ক্যালসিয়াম বা আয়রন সাপ্লিমেন্টের সাথে অন্তত ৪ ঘণ্টা ব্যবধান রাখা ভালো।
খাদ্যাভ্যাস: আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ, ডিম ও দুধ গ্রহণ করা উচিত।
নিয়মিত ফলোআপ: চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রতি দেড় থেকে ৬ মাস পরপর রক্ত পরীক্ষা করে ওষুধের ডোজ ঠিক করা উচিত।
পরিশেষে, হাইপোথাইরয়েডিজম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি রোগ। সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা পেলে এই রোগের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), রেসিডেন্ট, বিএসএমএম