জিন্স মানেই অনেকের মাথায় প্রথমে আসে আমেরিকার কথা। একসময় সত্যিও ছিল সেটাই। ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খনিতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য টেকসই কাপড়ের প্যান্ট বানিয়েছিলেন লিভাই স্ট্রস। সেই থেকে জিন্স হয়ে উঠেছিল শ্রমিকদের পোশাক।
পরবর্তীতে জেমস ডিন, মারলন ব্র্যান্ডোর মতো হলিউড তারকারা এই প্যান্টকে বানিয়ে ফেললেন স্টাইল আর বিদ্রোহের প্রতীক। কিন্তু আজকের দিনে জিন্স কি আর শুধু আমেরিকার গল্প? মোটেই না।
জিন্স আসলে কতটা আমেরিকান?
কিন্তু আজকের দিনে জিন্স কি আর শুধু আমেরিকার গল্প? মোটেই না। আমেরিকার ফ্যাশন খাতের হিসাব-নিকাশ যারা রাখে, সেই আমেরিকান এপারেল এন্ড ফুটওয়ার এসোসিয়েশন (এিএফএ) এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদন বলছে, ‘আজকের দিনে আমেরিকায় বিক্রি হওয়া ৯৭ শতাংশ পোশাকই তৈরি হয় বিদেশে।’
মানে হলো, আপনি আমেরিকার কোনো নামী ব্র্যান্ডের জিন্স কিনলেও, তার সিংহভাগ অংশ এসেছে অন্য কোনো দেশ থেকে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক কিংবা পেরু।
এই আন্তর্জাতিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলছে সাম্প্রতিক ট্যারিফ বা আমদানি শুল্ক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন এক শুল্ক নীতির ঘোষণা দিয়েছেন, যেখানে চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ থেকে আনা পোশাকের উপর লেগেছে উচ্চ কর। এই কর গড়ে সাধারণ আমদানি পণ্যের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। যদিও নব্বই দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে এই শুল্ক।
একটা জিন্স তৈরিতে কত দেশ লাগে?
ধরা যাক আপনি এওয়াইআর ব্র্যান্ডের একটি জিন্স কিনেছেন। এই ব্র্যান্ডটি মূলত ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের প্যান্ট ডিজাইন, কাটা এবং সেলাই সবই হয় আমেরিকায়।
তবে সেই জিন্স তৈরির উপাদানগুলোর মধ্যে ডেনিম কাপড় আসে তুরস্ক থেকে, লেবেল আসে ভিয়েতনাম থেকে, বোতাম ও চেইন আসে চীন থেকে, সিল্ক আসে এশিয়া থেকে, সুতা (পিমা কটন) আসে পেরু থেকে, লিনেন আসে আয়ারল্যান্ড থেকে আর মেরিনো পপলিন পাওয়া যায় কেবল ইতালির একটি কারখানায়।
মানে একটা জিন্স যেন ছোট্ট একটা দুনিয়া। যার প্রতিটি অংশ আলাদা আলাদা দেশের। আপনারটিও তাই।
ট্যারিফ কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
নতুন শুল্ক নীতির ফলে চীন থেকে আনা জিনিসের উপর ১২৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে আসা উপকরণে ৪৬ শতাংশ এবং তুরস্ক থেকে আনা ডেনিমের উপর ১০ শতাংশ কর ধার্য হয়েছে। এর মানে হলো, একটি জিন্সের দাম শুধু কাঁচামালের কারণে কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। যদিও কিছু দেশের জন্য ৯০ দিনের বিরতি ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও জিনিসটা খুবই জটিল এবং অনিশ্চিত।
ছোট ব্র্যান্ড বেশি বিপদে
এওয়াইআরের প্রধান নির্বাহী ম্যাগি উইন্টার বলছেন, ‘আমরা অনেকটাই দেশে উৎপাদন করি, কিন্তু আমাদের কাপড় আসে বিদেশ থেকে। তাই আমাদের ওপরও প্রভাব পড়ছে।’ তবে তারা কিছুটা নিরাপদ কারণ, তাদের উৎপাদন এবং বিক্রি দুইই আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
কিন্তু যেসব ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি কাঁচামালে নির্ভর করে, এবং খুচরা বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা চালায়, তাদের পরিস্থিতি কঠিন। ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন বলছে, ‘ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এই অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে পারছে না। ফলে তারা পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।’
কী হতে পারে সামনে?
এই ট্যারিফ পরিস্থিতি কতদিন চলবে, আর কে কিভাবে মানিয়ে নেবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এক জিনিস নিশ্চিত—এর প্রভাব পড়বে সবখানে। ফ্যাশন ডিজাইনার, ছোট ব্যবসা এবং সাধারণ গ্রাহক, কেউই বাদ যাবে না। আমরা যারা দোকানে গিয়ে বা অনলাইনে জিন্স কিনি, তারা জানিও না, সেই জিন্স তৈরির পেছনে কতগুলো দেশ, শ্রমিক, নীতি আর কৌশল কাজ করেছে।
জিন্স এখন আর শুধু আমেরিকার গল্প নয়। এটা পুরোপুরি এক গ্লোবাল পণ্য। যার প্রতিটি সেলাই, বোতাম আর ট্যাগের পেছনে আছে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ছোঁয়া। নতুন শুল্ক নীতির কারণে সেই জিনিসটা এখন আরও ব্যয়বহুল, জটিল এবং অনিশ্চিত। আর এর খেসারত দিচ্ছে, ছোট ব্যবসা আর আপনি, আমি, সাধারণ ক্রেতা।
তথ্যসূত্র: ইনস্টাইল