জাতিসংঘ ২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। শুধু অর্থনীতিক গুরুত্ব নয়, এই দিনটি চা-কে বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়। তিব্বতের পো চা থেকে শুরু করে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট চা পর্যন্ত, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে চা একতা, আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বের প্রতীক।
চায়ের সঠিক উৎপত্তি স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। জাতিসংঘের মতে, এটি উত্তর-পূর্ব ভারত, উত্তর মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের অঞ্চল থেকে উদ্ভূত। চীনে চা পানের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো।
চায়ের রাজত্বে শীর্ষে চীন, দ্বিতীয় ভারত
গরম ও আর্দ্র জলবায়ু, এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই সবচেয়ে ভালো জন্মায় চা। তাই চা চাষ হয় সাধারণত পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। শুধু চা পানের অভ্যাস নয়, এই চা চাষ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের জীবিকা।
টি অ্যান্ড কফি ট্রেড জার্নালের ‘গ্লোবাল টি রিপোর্ট’ এর সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত চায়ের প্রায় ৪৮ শতাংশই আসে চীন থেকে। অর্থাৎ বিশ্বের অর্ধেকের কাছাকাছি চা উৎপাদন হয় এই দেশটি।
এরপরেই রয়েছে চায়ের আরেক বড় নাম ভারত। দেশটিতে বিশ্বের ২০ শতাংশ চা উৎপাদিত হয়। ভারতের দার্জিলিং, আসাম, নীলগিরি অঞ্চলে চায়ের চাষ বহু পুরনো এবং বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। তৃতীয় স্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়া, যেখানে ৮ শতাংশ চা উৎপাদিত হয়।
এরপর তুরস্ক উৎপাদন করে ৪ শতাংশ, আর শ্রীলঙ্কা আসে ৫ নম্বরে, যেখানে চায়ের উৎপাদন ৩ শতাংশ। এই পাঁচটি দেশের বাইরে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ মিলে বাকি ১৭ শতাংশ চা উৎপাদন করে।
চা শুধু এক কাপ পানীয় নয়। অনেক দেশের সংস্কৃতি, অভ্যর্থনা, অর্থনীতি এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। বিশ্বজুড়ে চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে চাহিদা ও উৎপাদনও।
প্রতিদিন কত চা পান করা হয় সারা বিশ্বে?
চায়ের দেশ বলতে আমরা অনেকেই শুধু ভারত বা চীনকেই ভাবি। কিন্তু চা এখন গোটা বিশ্বের প্রিয় পানীয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৫ লাখ টন চা পান করা হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই পরিমাণ আরও বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি চা পান করে চীন। একাই পান করেছে ৩০ লাখ টন। যা মোট চায়ের ৪৬ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে ভারত। ১১.৬ লাখ টন, যা মোট চায়ের ১৮ শতাংশ। তালিকায় এরপর আছে তুরস্ক (২.৫ লাখ টন), পাকিস্তান (২.৪৭ লাখ টন) ও রাশিয়া (১.৩৩ লাখ টন)।
এফএও বলছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চা পানের হার ২ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০২৩ সালেও সেই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। তবে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় চা পানের পরিমাণ একটু কমেছে। কফি, সফট ড্রিংকসহ নানা পানীয় বাজার দখল করে নিচ্ছে। আর রাশিয়াতে চা আমদানিতে প্রভাব পড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে।
বিশ্বজুড়ে অদ্ভুত পাঁচ চা
চা মানেই শুধু দুধ আর চিনি নয়। অনেক দেশেই চা তৈরি হয় একেবারে ভিন্নভাবে। চলুন, দেখে নিই পাঁচটি ব্যতিক্রমী চায়ের ধরন।
বাটার টি (পো চা), চায়ে লবণের স্বাদ
তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী পানীয় পো চা বা বাটার টি একেবারে আলাদা ঘরানার চা। এই চা বানাতে ব্যবহার করা হয় যাকের (গরুর মতো এক ধরনের পশু, যা ঐ অঞ্চলে পাওয়া যায়) দুধ থেকে তৈরি মাখন, লবণ ও কালো চা পাতা। এই চায়ের স্বাদ একেবারে ঝোলের মতো, হালকা নোনতা ও ঘন।
এই চায়ের আরেকটা মজার দিক আছে, তিব্বতি আতিথেয়তার অংশ হিসেবে। অতিথির কাপ বারবার ভরে দেওয়া হয় এই বাটার টি দিয়ে। অতিথি নিজে না বলা পর্যন্ত কাপ খালি হলে তা আবার ভরে দেওয়া হয়। আর যদি হোস্ট চা আর না দেন, তবে বুঝে নিতে হয় আপনার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
পো চা শুধু শরীর গরম রাখার জন্য নয়। উচ্চপাহাড়ি অঞ্চলের জীবনযাত্রায় এটি একটি দরকারি পুষ্টিকর পানীয় হিসেবেও ধরা হয়।
কম্বুচা, এটা কি চা?
চা বলতে আমরা বুঝি কড়া দুধ চা, কখনও লেবু চা। কিন্তু কম্বুচা একেবারে ভিন্ন ঘরানার। এটা এক ধরনের ফারমেন্টেড চা, যা বানাতে লাগে ব্যাকটেরিয়া আর ইস্ট।
প্রথমে মিষ্টি চা বানানো হয়। এরপর এতে যোগ করা হয় এক ধরনের জেলির মতো জীবন্ত বস্তু স্কোবি। এই স্কোবি চায়ের মধ্যে রেখে এক সপ্তাহের মতো রেখে দিলে তা ধীরে ধীরে গাঁজন হয়। এক ধরনের হালকা টক, মিষ্টি আর ফিজি পানীয়তে রূপ নেয়। এটাই হলো কম্বুচা।
কম্বুচার আরেকটা অদ্ভুত দিক হলো স্কোবিকে অনেকে নিজের পোষা প্রাণীর মতো যত্ন করেন। কেউ নাম রাখেন, কেউ ফ্রিজে রেখে যত্ন করেন। আবার কেউ বন্ধুদের উপহারও দেন পুরনো স্কোবি থেকে তৈরি নতুন স্কোবি। এ যেন পারিবারিক ঐতিহ্য।
অনেকে বলেন, কম্বুচা হজমে সহায়তা করে, শরীর ডিটক্স করে। তবে যেহেতু এটা ফারমেন্টেড পানীয়, তাই বাড়িতে বানানোর সময় একেবারে পরিষ্কারভাবে বানানো জরুরি, না হলে ক্ষতি হতে পারে।
স্বাদে টক-মিষ্টি আর গ্যাসযুক্ত এই পানীয় এখন শুধু পূর্ব এশিয়ায় নয়। সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য সচেতনদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। চায়ের তালিকায় এটি নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রম।
বাটারফ্লাই পি ফ্লাওয়ার টি
এই চা শুধু স্বাদে নয়, রঙেও চমকে দেয়। বাটারফ্লাই পি ফ্লাওয়ার টি বা সংক্ষেপে ‘ব্লু টি’ নামে পরিচিত। এই পানীয় তৈরি হয় নীল রঙের এক ধরনের ফুল দিয়ে, বাটারফ্লাই পি ফ্লাওয়ার।
চায়ের পানিতে এই ফুলের পাপড়ি ফুটিয়ে নিলে পানীয়টা হয়ে যায়। একেবারে গাঢ় নীল রঙের। কিন্তু মজাটা তখনই, যখন আপনি এতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মেশান। চায়ের রঙ মুহূর্তেই বদলে যায়। নীল রঙ বদলে গিয়ে হয়ে যায় বেগুনি।
এই চা পুরোপুরি ক্যাফেইন মুক্ত। তাই যারা চা পান করতে চান, কিন্তু ক্যাফেইনের কারণে দ্বিধায় থাকেন। তাদের জন্য এটা দারুণ এক বিকল্প।
স্বাদে হালকা ফ্লোরাল, কখনও একটু মাটির গন্ধও পাওয়া যায়। অনেক সময় এতে মধু বা লেবু মিশিয়ে পান করা হয়। স্বাস্থ্যগুণের দিক থেকেও অনেকে একে ভালো বলেন। চোখের যত্ন, হজমের সহায়তা, এমনকি মানসিক প্রশান্তিতেও কাজ করে বলে দাবি করেন অনেকে।
দেখতেও সুন্দর, পান করতেও আলাদা। এই চা যেন চোখ আর জিভ, দুটোতেই চমক দেয়।
বাওবাব পাতার চা, গুণে ভরপুর
চায়ের পাতা মানেই যেন ফুলেল সুবাস বা মিষ্টি স্বাদ। কিন্তু বাওবাব পাতার চা এই ধারণা বদলে দেয়। সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক জায়গায় বাওবাব গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় এই চা। এটি মূলত একটি হারবাল পানীয়। যেটিকে ঐ অঞ্চলে হালকা ওষুধি গুণসম্পন্ন ও পুষ্টিকর পানীয় হিসেবে ধরা হয়।
স্বাদে অবশ্য এই চা অনেকটাই আলাদা। নেই কোনো মিষ্টি সুবাস। বরং এতে থাকে মাটির গন্ধের মতো হালকা কষাভাব। অনেকে একে পালং শাক ফোটানো পানির স্বাদের সঙ্গে তুলনা করেন।
যদিও স্বাদে ব্যতিক্রম। তবে এর স্বাস্থ্যগুণের জন্য একে নিয়মিত পান করেন অনেকেই। আফ্রিকার লোকজ চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয় হজমের সমস্যা, ঠান্ডা লাগা বা শরীরের দুর্বলতা কাটাতে।
বাওবাব পাতার চা দেখতেও খুব সাধারণ। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক যত্নের কাহিনি।
পেয়ারা পাতার চা, ঘরোয়া টোটকা
পেয়ারা গাছের পাতা দিয়ে যে চা বানানো যায়, তা অনেকেই জানেন না। পেয়ারা পাতার চা মূলত ভেষজ চা। যার ব্যবহার বহুদিন ধরেই প্রচলিত আছে বিশেষ করে ফিলিপাইন অঞ্চলে।
এই চায়ের স্বাদ হয় একটু মাটির মতো হালকা কষা ও ধোঁয়াটে ধরনের। কিন্তু স্বাদ ছাড়িয়ে এর জনপ্রিয়তার আসল কারণ হলো এর ঔষধিগুণ। ফিলিপাইনের লোকজ চিকিৎসায় এই চা ব্যবহৃত হয় পেটব্যথা, হজমের সমস্যা ও মুখ বা ত্বকের ঘা ধোয়ার জন্য।
শুধু পানীয় হিসেবেই নয়। কখনো কখনো পেয়ারা পাতার রস ব্যবহার করা হয় ঘা বা ক্ষত পরিষ্কার করতেও।
পেয়ারা পাতার চা প্রাকৃতিক ও সহজলভ্য একটি প্রতিকার। যার পেছনে রয়েছে বহু প্রজন্মের স্বাস্থ্যজ্ঞান আর ঘরোয়া যত্নের কাহিনি। এই চা এখন ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়েই স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
চা শুধু একটি পানীয় নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আতিথেয়তার প্রতীক। আজ আন্তর্জাতিক চা দিবসে বিশ্বজুড়ে সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ চায়ের জগতে ঢুকে পড়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কাপে কাপে শুধু স্বাদই নয়, মিশে থাকে একেকটা সমাজের গল্প।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা