প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এক বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর অন্তর্বর্তী মেয়াদে প্রধান যে কাজগুলো সম্পন্ন করতে চান, সে বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাজগুলো হচ্ছে নির্বাচন-ব্যবস্থা, বিচার-ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা।’
অধ্যাপক ইউনূস সঠিকভাবেই এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। সুষ্ঠু রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য জরুরি এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই স্বৈরাচারী সরকার অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, কিন্তু ততদিনে দুর্বল হয়েছে রাষ্ট্র। তাই এখন জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যে-সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে কাজ করার দায়িত্ব ছিল, তারা ব্যর্থ হয়, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে এবং শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার সাধনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমও এইসব ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে নয়। সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে সহায়তা করার মাধ্যমে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে স্বীকৃত সংবাদমাধ্যমও গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে মোটের ওপর ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণ শুধু গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ দুর্বল কাঠামো নয়, বরং বৈরী রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশও দায়ী।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা এতটাই ছিল যে, তারা স্বাধীন ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এই অবস্থা অনেকটা ১৭৮০ সালের মতো, যখন ‘হিকির বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই সাপ্তাহিক ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলাপিডিয়া বলছে, সাপ্তাহিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকি ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির সমালোচনা করতেন। পরিণাম হিসেবে দুই বছরের মধ্যেই (১৭৮২ সালে) পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং হিকি সাহেব ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন।
দেশে বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু আইন কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩; প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৩; প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৭৪; কনটেম্পট অব কোর্ট অ্যাক্ট, ২০১৩; এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩, যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮- বাতিল হওয়ার পর প্রণয়ন করা হয়। এই আইনগুলোর ক্ষতিকর ধারাগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এছাড়াও, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪)-এর মতো আইনগুলোও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে।
আরও কিছু আইন ও নীতিমালার খসড়া বিগত স্বৈরাচারী সরকার করে গেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ডিজিটাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কিত খসড়া প্রবিধান, ২০২১; ওটিটি কনটেন্ট-ভিত্তিক সেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতি, ২০২১; এবং গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্ত) আইন, ২০২২-এর বেশ কিছু ত্রুটিপূর্ণ ধারা রয়েছে, যা কেবল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, সামগ্রিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত একটি কমিটি বা কমিশনের মাধ্যমে সংবিধান ও মতপ্রকাশের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ধারাগুলোকে চিহ্নিত করে তা সংশোধন বা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সংবিধান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ৩৯ ধারা অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এই অধিকারগুলো ‘যুক্তিসংগত আইনি সীমাবদ্ধতা’-এর আওতায় রাখা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা রক্ষা, আদালত অবমাননা, মানহানি, বা অপরাধ উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
যেহেতু মুক্ত সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার মূল চালিকাশক্তি, তাই এটি যেন কোনো রকম বাধা ছাড়া কার্যকর থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রশাসক এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের সাংবাদিকদের কাজে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সাংবাদিকরা যেন অভিযোগ দাখিল করে দ্রুত প্রতিকার পেতে পারেন, সে জন্য বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করা উচিত।
নতুন বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক যেন হুমকি, চাপ, হয়রানি, নজরদারি বা ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের শিকার না হন—এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি দায়িত্ব। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি রাষ্ট্রকে সম্মান দেখাতে হবে। রাজনীতিবিদ ও সরকারকে মেনে নিতে হবে জবাবদিহির স্বার্থে সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন করে যাবে প্রতিনিয়ত।
১৯৭৪ সালের প্রেস কাউন্সিল আইনে প্রতিষ্ঠিত প্রেস কাউন্সিলকেও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শক্তিশালী করা জরুরি, যাতে ক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষগুলো নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তাদের অভিযোগের প্রতিকার পেতে পারেন। এক্ষেত্রে, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোত্তম চর্চাগুলোকে অনুসরণ করা যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সংবাদমাধ্যমের সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং বণ্টন নীতিমালা তৈরি করতে হবে। ডিএফপি (ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স) যে পদ্ধতিতে সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দের জন্য সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা তালিকা তৈরি করে, তাতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড থেকে সরবরাহ করা টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) পদ্ধতিও আরও নির্ভরযোগ্য করা যেতে পারে, যদি বেশি সংখ্যক বাড়িতে টিআরপি ডিভাইস স্থাপন করা হয়। এর ফলে জরিপের ফলাফল আরও প্রতিনিধিত্বমূলক হবে।
বছরের পর বছর বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের মতো রাষ্ট্র পরিচালিত সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখনই সময় অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়টি সমাধান করুক, যাতে জনগণের করের টাকা অপচয় না হয়।
ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত বিবিসিকে একটি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে বোর্ডের দায়িত্ব হলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর তদারকি করা আর এক্সিকিউটিভ কমিটি দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে।
এছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বিএসএস (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা)-এ প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পারফরম্যান্স টার্গেট নির্ধারণের মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে সংস্থাটি দক্ষ ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে।
গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদমাধ্যমকে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বা রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়–যা নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পাশাপাশি অবস্থান করে। এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে জনগণকে তথ্য দিয়ে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সহায়তা করা।
সাংবাদিকরা প্রায়ই নিজেদের ‘চতুর্থ অঙ্গ’-এর অংশ হিসেবে দাবি করতে গর্ববোধ করেন। সেক্ষেত্রে, মানুষের আস্থা অর্জন করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাদেরও সাংবাদিকতার আড়ালে দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি কোনো সাংবাদিক সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চান, তবে তাঁর পেশা ত্যাগ করেই রাজনীতিতে নামা উচিত।
সম্প্রতি এক নির্দেশনায় সব সরকারি কর্মকর্তাকে তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের পর সব বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ২.০-তে অন্যান্যদের অনুসরণ করে রাষ্ট্রের 'চতুর্থ অঙ্গ'-এর সদস্যরা (সাংবাদিকরা) কি স্বেচ্ছায় তাদের সম্পদের ঘোষণা দিতে পারেন? যদি সাংবাদিকেরা এ পদক্ষেপ নেন, তবে তারা ক্ষমতাসীনদের কাছে সঠিক প্রশ্ন করার আরও কার্যকর অবস্থানে থাকবেন।
(এই নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত।)
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]