ক’দিন আগের কথা। সপ্তাহের অফিস খোলা কর্মদিবস। স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় চাপ আছে মানুষের, যানেরও। তবে সকাল ১০টার পর সেই চাপ একটু হলেও কমে আসে। তেমনই এক সময়ে রাজধানীর একটি ব্যস্ততম রাস্তা পার হতে হচ্ছিল। কিছুটা দূরেই ছিল বাস, অটোরিকশা। সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রাইভেট কারটিও বেশ খানিকটা দূরেই ছিল।
ফলে পায়ে হাঁটা স্বাভাবিক গতিতেই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চিন্তা করা হয়। এই অধমের সঙ্গী ছিলেন আরও কয়েকজন অচেনা পথচারী। গাড়িগুলোর গতিও তেমন ছিল না। ফলে সিগন্যাল দিয়ে সবাই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টায় মন দিয়েছিল।
কিন্তু অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পরই মনে হলো, আসতে থাকা প্রাইভেট কারটির হুট করেই শুরু হয়েছে তাড়াহুড়ো। তাই গতি গেল বেড়ে, সঙ্গে মুহুর্মুহু হর্ন। সেটা এমনভাবেই, যাতে মনে হলো, তাড়াতাড়ি রাস্তা পার না হতে পারলে, হয়তো গায়ের উপরই তুলে দেবে গাড়ি! তাই পথচারীরা কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়েই পায়ের গতি বাড়ালেন। কেউ কেউ তো খানিকটা দৌড়েই পার হলেন রাস্তা। আর সেই প্রাইভেট কারটি এমনভাবে জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে গেল, যেন দ্রুত ওই ক্রসিং পার না হতে পারলে দুনিয়াই উল্টে যাবে!
এমন ঘটনা বেশ স্বাভাবিক এই রাজধানী শহরে। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, এমন কাজ করে বাস, ট্রাক থেকে শুরু করে মোটরসাইকেল ও রিকশা পর্যন্ত। রিকশা তো আবার দুই প্রকার। পায়ে টানা রিকশা এ ক্ষেত্রে কিছুটা সচেতন থাকলেও, ব্যাটারিচালিত রিকশার ভাব সেই। এসবের অবস্থা দেখলে মনে হয়, তাদের কোন ব্রেকই নেই!
বিশ্বাস না হলে, একদিন রাস্তা পার হওয়ার সময়কার বাস্তব অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখুন। বুঝতে পারবেন যে, রাস্তা পার হওয়ার সময় পথচারীকে কীভাবে দৌড়াতে বাধ্য করা হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এর উল্টোটাও যে নেই, তা নয়। অনেক গাড়ি আবার পথচারীকে রাস্তা পার হতে দেখলেই গতি কমিয়েও আনে। তবে নিজের অভিজ্ঞতায় এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এমন সচেতন চালকের সংখ্যা দশে এক বা তারও কম। বেশির ভাগই গতি বাড়িয়ে দেয় এমনভাবে, যেন পাগলা ঘোড়া রাস্তায় নেমেছে!
অথচ এই পুরো বিষয়টাই অহেতুক। চালকেরা যখন দেখছেনই যে, পথচারীরা রাস্তা অতিক্রম করছেন, তখন একটু ধীরে–সুস্থে চালালে, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? কিন্তু ঘটে পুরো উল্টো ঘটনা। কাউকে রাস্তা অতিক্রম করতে দেখলেই যেন গাড়ির চালকদের মনে পড়ে যায় যে, গতি বড্ড কম হয়ে যাচ্ছে! তারা গতি বাড়িয়ে দেন। আর তাতে পথচারীদের মধ্যেও তৈরি হয় তাড়াহুড়ো, দেখা দেয় দৌড়ানোর প্রবণতা। এতে করে দুর্ঘটনাও ঘটে অহরহ।
একটু হিসাবে চোখ বোলানো যাক। চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৮৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬০৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৩১ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এই হিসাব জানিয়েছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে যে, মার্চ মাসে ২৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৩৩ জন, যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৮২টি দুর্ঘটনায় ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন। রাজধানী ঢাকায় ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ৫৩ জন আহত হয়েছেন। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় ৫৭৮ জন নিহত হয়েছিলেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে, অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে যে, সড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত গতি সব সময়ই ডেকে আনে দুর্গতি। এতে মানুষের প্রাণও যায় হরদম। যার প্রাণ যায় না, তার জীবনে থেকে যায় ক্ষত। কিন্তু তারপরও যানবাহনের চালকদের সচেতন হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না খুব একটা। মাঝে মাঝে তো মনেই হবে যে, রাস্তাটা মনে হয় শুধু যানবাহনেরই। যাত্রী বা পথচারীরা সেখানে উটকো ঝামেলা কেবল!
হ্যাঁ, উল্টো দিকেও যে দোষ নেই, তা নয়। অনেক সময় পথচারীরাও ভুল করেন। সচেতন না হয়েই রাস্তা পার হতে যান, কখনো কখনো অযাচিতভাবেই চলে আসেন গাড়ির সামনে। এতেও দুর্ঘটনা ঘটে বৈকি। তবে গাড়ির চালকদের (তা যে ধরনের যানই হোক না কেন) কিছুটা বাড়তি সচেতনতা ও সাবধান থাকা অতীব প্রয়োজন। কারণ মানুষের ধাক্কায় গাড়ির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে না। তবে গাড়ির ধাক্কায় মানুষের জান যায় অবশ্যই।
সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে আমাদের দেশে যথেষ্ট আইনকানুনও আছে। কিন্তু চালক বা পথচারী—সবাই কেন জানি এসব জানা, বোঝার ক্ষেত্রে উদাসীন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদ্যোগেও ঘাটতি আছে নিশ্চয়ই। মাঝে মাঝেই এ ধরনের সংস্থাগুলোর সদস্যদের অনিয়ম, দুর্নীতিও প্রকাশ্যে আসে বটে। এভাবেই আইনের ফাঁক গলে তৈরি হয় মরণফাঁদ। তবে দিনশেষে নিজেদের জান বাঁচাতে নিজেদরই তো বাড়তি সচেতন থাকা প্রয়োজন, তাই না?
মোদ্দা কথা হলো, রাজধানীসহ সারা দেশেই যানবাহনের অতিরিক্ত গতিতে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণও যাচ্ছে শত শত মানুষের। রাস্তা পার হতে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হওয়ার পরিমাণও কম নয়। অথচ একটু সতর্ক হলেই কিন্তু ঠেকানো যায় এমন প্রাণক্ষয়। চালকেরা ও পথচারীরা যদি নিজের নিজের অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে ওঠেন, সহমর্মী হয়ে ওঠেন, তাহলেই হয়। না হলে কিন্তু কোনো একদিন হয়তো সড়কে কারও মরে পড়ে থাকার দায় আপনাদের ঘাড়েই আসীন হবে! তখন সেই মনোযন্ত্রণা সইতে পারবেন তো?
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]