ঘটনা ১: সম্প্রতি নারী কমিশনের দেওয়া প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে কিছু নারী প্রতিবাদ করছিলেন। সেখানে একজন নারী ক্যামেরার সামনেই সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলছিলেন কেন নারী কমিশনের প্রস্তাব, এমনকি পুরো কমিশনই বাতিল করা প্রয়োজন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘নারী হচ্ছে ঘরের জন্য তৈরি’।
ঘটনা ২: নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিশাল এক সমাবেশ হলো রাজধানী ঢাকায়। সেখানে নারী কমিশনের সদস্যদের ছবি দিয়ে প্ল্যাকার্ড বানিয়ে তাতে জুতা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। সেই সমাবেশে নারী কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর বিশেষণ ব্যবহার করলেন অনেক বক্তা। এক কথায়, সমাজে প্রচলিত গালিই দেওয়া হলো। ওই সমাবেশে আবার অনেক নতুন, পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা গিয়ে সংহতিও জানিয়ে আসলেন।
ঘটনা ৩: রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হওয়া বিশাল সেই সমাবেশের দিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে থাকা রাজু ভাস্কর্যে ফাঁসিতে ঝোলানো এক শাড়ি পরা কুশপুত্তলিকাকে বেদম জুতার বাড়ি দেওয়া হলো। ক্ষোভ প্রকাশের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটতেই পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কিছু মানুষ সেই কুশপুত্তলিকার শাড়িই খুলে ফেললেন পুরোপুরি ইচ্ছাকৃতভাবে। এমনভাবে, যেন শাড়ি খুলে ফেলাটাই প্রধান লক্ষ্য ছিল!
আরও পড়ুন:
এই সবগুলো ঘটনাই গত কিছুদিনের মধ্যে ঘটেছে। এসবের ভিডিওচিত্রে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সয়লাব। তবে নারী ইস্যুতে দেশে যে গত কয়েকদিনেই হল্লা শুরু হলো, বিষয়টা তা নয়। বরং এটি গত কয়েক মাস ধরে চলা একটি ধারাবাহিক হট্টগোলের চূড়ান্ত রূপ, যাতে বিদ্বেষের প্রাবল্য অনেক বেশি। এবং ওপরের ওই তিনটি ঘটনা কেবলই নারীর প্রতি বিরূপ পরিবেশের উদাহরণসমগ্রের বিশাল হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
প্রথম ঘটনায় একজন নারীই যেভাবে নারী কমিশনের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘নারী হচ্ছে ঘরের জন্য তৈরি’ বললেন, সেটি প্রকাশ্যে বলার অধিকার তার অবশ্যই আছে। একজন নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারই তাকে সেই সুরক্ষা দেয়। তবে সমস্যা হলো, এ ধরনের কথা শুধু তো নারীদের একটি অংশই বলছে না। বলছে দেশের পুরুষদের আরেকটি বিরাট অংশও। এবং নারীকে অন্তঃপুরের স্থায়ী বাসিন্দা বানানোর এমন বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই চাপিয়ে দেওয়া ঘরানার।
অর্থাৎ, বিষয়টি এমন যে, শুধু যারা ঘরে থাকতে চায় তারা নয়, বরং যারা ঘরে থাকতে চায় না, তাদেরও ঘরেই থাকতে হবে। আর এই জায়গাতেই সমস্যা। যারা এটি মানবে না, বা মানতে চায় না, তারা তা প্রকাশ্যে বললেই লেগে যায় গণ্ডগোল। শুরু হয় তাদের নানাভাবে হেয় করার কার্যকলাপ।
এই হেয় করার কার্যকলাপের মধ্যেই পড়ে ওপরে বর্ণিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনাটি। এসবে ব্যক্তি নারীকে আক্রমণ করার ছলে, আসলে সব নারীকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, সম্ভাব্য অসম্মান ও অপমানের মাত্রা আসলে কতটা হতে পারে! এ ধরনের ঘটনাবলীকে যারা ইনিয়ে‑বিনিয়ে নানা তরিকায় ব্যাখ্যা‑বিশ্লেষণ করে ‘সুশীল’ আকার দিতে চান, তারা দিনশেষে সেই পুরুষতন্ত্রেরই সমর্থক, যেটি এ দেশের নারীদের সব সময় পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখারই সমার্থক। এখন সেই পায়ের নিচে বোন থাকুক, বউ থাকুক, কিংবা মা–কিচ্ছু আসে যায় না!
আরও পড়ুন:
নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক যৌন হেনস্তা, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬/১৭ দিন আগে একটা কলাম লেখা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল–‘নারীদের মানুষ না ভাবার নদীমাতৃক এক দেশে’। ওই লেখাতে থাকা কিছু কথাই আবার বলতে হচ্ছে দুর্ভাগ্যক্রমে। সেটি হলো, আমাদের এই বাংলাদেশে নারীদের যতটা বিমানবিকীকরণ করার চেষ্টা দেখা যায়, যতটা খেলো করার প্রচেষ্টা চলে, সেসবের ফিরিস্তি দিতে গেলে লাখ লাখ দিস্তা কাগজের প্রয়োজন হবে। এসবের মধ্য দিয়ে আদতে একটি প্রকট পিতৃতান্ত্রিক চেহারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যেখানে নারীকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয় না আর। এবং এই বিকট দৃষ্টিভঙ্গিটাই এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল।
অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সংস্কারের উদ্দেশে নানা ধরনের কমিশন গঠন করেছে। নারী কমিশনও সেসবের মধ্যে একটি। এসব কমিশন মূলত বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, কমিশন বলল, আর সব হয়ে গেল। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্যের ব্যাপার আছে, জনগণের ইচ্ছা‑অনিচ্ছারও ব্যাপার আছে। সুতরাং আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানানোর সুযোগ সব পক্ষেরই থাকছে। কিন্তু নারী কমিশনের ক্ষেত্রে যেভাবে জোর করে বাতিল করার একটি চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, সেটি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, নারীর অধিকার কেমন হবে, তা ঠিক করে দেওয়ার ঠিকা নিয়েছেন পুরুষেরা! এবং তাতে যেভাবে পেশি ও গলার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করা হচ্ছে, তাতে অন্তত নারীর সমান ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার কোনো প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষও মতের দিক থেকে বেশ দ্বিধাবিভক্ত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচারিত হম্বিতম্বি দেখলে তো মনে হয়, আপামর নারীদের পা বেঁধে ফেলা উচিত, আর মুখেও স্কচটেপ লাগিয়ে দেওয়া উচিত! আশ্চর্যের বিষয় আরো যে, আগের দিনে এমন ঘটনায় নারীর স্বাধীনতা নিয়ে ‘জ্বলন্ত প্রতিবাদী’ বাক্যসমগ্র দিয়ে স্ট্যাটাস ও কলামে সোশ্যালসহ বিভিন্ন মিডিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া স্বঘোষিত ‘বুদ্ধিজীবী’রা হুট করেই নারী কমিশনের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন। তারা এখন বলছেন ‘বাস্তবসম্মতা’র কথা, তারা তুলে আনছেন পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতার প্রসঙ্গ। তা, দেশ চালাতে চান পাশ্চাত্য থেকে আনা গণতান্ত্রিক মডেলে, চড়ছেন পাশ্চাত্যের কোম্পানির তৈরি গাড়িতে, কম্পিউটার কিনতে গেলেও খোঁজেন ওখানকারই ম্যানুফ্যাকচারার, বড় বড় সরকারি পদে বসতে দেখা যাচ্ছে দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যক্তিদের, গরমের দিনে ঘরে লাগাতেও চান পাশ্চাত্য প্রযুক্তিতে তৈরি এসি, রাজধানীর রাস্তাতেও বসাতে চান বিদেশি পিউরিফায়ার ইত্যাদি ইত্যাদি, খালি নারীর প্রসঙ্গেই এত ‘দেশ’ টানেন কেন? এই শব্দ দিয়ে তৈরি মুখোশে মুখ ঢেকে অধিকারহরণ সহজ হয় বলে? নাকি, ক্ষমতা আপনাদের কাছেও এখন লেহ্য বস্তু?
আরও পড়ুন:
অথচ, আমাদের এই বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় বর্তমানে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। সেই ২০২২ সাল থেকেই বেশি। একটি দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বিতর্কিত করে, দমন করার চেষ্টা করে, কেবলই পুরুষের যৌনবস্তু হিসেবে সাব্যস্ত করে, প্রতিনিয়ত অপমান‑হেনস্থা করে আর যাই হোক দেশের সার্বিক উন্নতি আনা সম্ভব নয়। দেশের অর্ধেক মানুষকে যদি ঘরেই ঢুকিয়ে দেন বা ঢুকে যেতে বাধ্য করেন–তাহলে আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোর আসবে কীভাবে? পুঁজিবাদী যে ব্যবস্থায় আমাদের বসবাস, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নতিই সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। ভাইলোক, নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই দিকটাও একটু ভেবে দেখবেন প্লিজ!
এই রচনাটা লেখার সময়ই আরও দুটি ঘটনা সামনে এল। একজন নারী সাংবাদিক এবং একজন নারী শিক্ষককে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্রেফ ‘মনের সুখে’ অশ্রাব্য গালিগালাজ করা হচ্ছে। সেসব পোস্টের কমেন্ট থ্রেডে ঢুকলে মনে হবে, এই বাংলাদেশে শুধু যৌন বিকারগ্রস্ত পুরুষদেরই বাস! তা এই পুরুষেরা নিজেদের ঘরে মা‑বোনদের আসলে কোন দৃষ্টিতে দেখেন? আরেক অচেনা নারীকে যেভাবে দেখেন, সেভাবেই কি?
এসব ঘটনা এখন খুবই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন একে আরও স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। সরকার অবশ্য কেবল হম্বিতম্বি করেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছে, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে নারীকে অসম্মানের, অপমানের ভাইরাস ছড়াচ্ছে বাতাসের গতিতে। মাঝে মাঝে দুরু দুরু মনে অসহায় প্রশ্নটি উঠেই যাচ্ছে যে–এ দেশে নারী কি তবে শুধু গালি খাওয়ার জন্যই তৈরি?
এ প্রশ্নের উত্তর যাদের ইতিবাচক হবে, তারা দয়া করে আজ থেকেই নিজেদের ঘরে ও পরিবারেও এর প্রয়োগ শুরু করে দিতে পারেন। মা‑বোন, কন্যা বা স্ত্রীদেরও তো জানা দরকার তাদের ছেলে‑ভাই, বাবা বা স্বামী আসলে কেমন!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]