এটিই শেষ। গণহত্যার রক্তমাখা শেষ অধ্যায়। দ্রুতই সব শেষ হয়ে যাবে। খুব বেশি হলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। বিশ লাখ মানুষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। ইসরায়েলি গোলা, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, বোমা আর গুলিতে প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ হতাহত হচ্ছে। তাদের আরও জুটছে বিশুদ্ধ পানীয় জল, ওষুধ ও খাদ্যের অভাব। তারা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
এই ভয়াবহ গল্পের শেষ পাতাগুলোতে, ইসরায়েল নিষ্ঠুরভাবে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের খাবারের প্রলোভন দেখাচ্ছে। তাদের মিশর সীমান্তবর্তী নয় মাইল দীর্ঘ সংকীর্ণ ও জনাকীর্ণ ভূমির ফালিতে যাওয়ার লোভ দেখাচ্ছে। ইসরায়েল ও তাদের কপটভাবে নামাঙ্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও মোসাদ দ্বারা পরিচালিত বলে অভিযোগ, ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ গাজায় প্রলুব্ধ করছে, ঠিক যেভাবে নাৎসিরা ওয়ারশ ঘেটোর ক্ষুধার্ত ইহুদিদের মৃত্যুশিবিরে ট্রেনে উঠতে প্রলুব্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের খাওয়ানো নয়। কেউই গুরুত্ব সহকারে যুক্তি দেখায় না যে, পর্যাপ্ত খাবার বা ত্রাণ কেন্দ্র আছে। উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের কড়া পাহারায় রেখে নির্বাসিত করা।
এরপর কী হবে? আমি অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা ছেড়ে দিয়েছি। ভাগ্য আমাদের চমকে দেওয়ার পথ খুঁজে বের করে। কিন্তু গাজার এই মানব-কসাইখানায় একটি চূড়ান্ত মানবিক বিস্ফোরণ ঘটবে। আমরা তা দেখছি ফিলিস্তিনিদের ক্রমবর্ধমান ভিড়ে, যারা একটি খাবারের প্যাকেট পাওয়ার জন্য লড়াই করছে, যার ফলস্বরূপ ত্রাণ বিতরণের প্রথম আট দিনে ইসরায়েলি ও মার্কিন বেসরকারি ঠিকাদারেরা অন্তত ১৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে এবং সাত শতাধিক মানুষকে আহত করেছে। আমরা তা দেখছি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দ্বারা গাজার আইএসআইএস-সংশ্লিষ্ট গ্যাংগুলোকে অস্ত্র সজ্জিত করার মধ্য দিয়ে, যারা খাদ্য সামগ্রী লুট করছে। ইসরায়েল, যারা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (UNRWA)-এর শত শত কর্মচারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী এবং পুলিশকে হত্যা করেছে, তারা সুপরিকল্পিতভাবে নাগরিক সমাজের পতন ঘটিয়েছে।
আমার সন্দেহ, ইসরায়েল মিশর সীমান্ত বরাবর বেড়া ভাঙার সুযোগ করে দেবে। মরিয়া ফিলিস্তিনিরা হুড়োহুড়ি করে মিশরের সিনাইয়ে ঢুকবে। হয়তো অন্য কোনোভাবে এর শেষ হবে। কিন্তু এটি দ্রুতই শেষ হবে। ফিলিস্তিনিদের আর বেশি কিছু সহ্য করার নেই।
আমরা–এই গণহত্যার পূর্ণ অংশগ্রহণকারী–যারা গাজাকে খালি করা এবং বৃহত্তর ইসরায়েলকে বাড়িয়ে চলার উন্মাদ লক্ষ্য অর্জন করব। আমরা এই সরাসরি সম্প্রচারিত গণহত্যার ওপর পর্দা নামিয়ে দেব। আমরা হলোকাস্ট অধ্যয়নের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামগুলোকে উপহাস করেছি। এটা গণহত্যা বন্ধ করার জন্য আমাদের প্রস্তুত করতে নয়, বরং ইসরায়েলকে এমন এক চিরন্তন শিকার হিসেবে মহিমান্বিত করতে তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ‘আর কখনো নয়’–এই বাক্যটি এখন একটি প্রহসন। যখন আমাদের গণহত্যা থামানোর ক্ষমতা থাকে এবং আমরা তা করি না, তখন আমরা দোষী–এই বোঝাপড়া আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গণহত্যা একটি জননীতি। আমাদের দুটি শাসক দল দ্বারা এটি অনুমোদিত ও সমর্থিত।
বলার আর কিছু বাকি নেই। হয়তো আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। কেননা পক্ষাঘাতগ্রস্তরা কি কিছু অনুভব করে? হয়তো সেটাও একটা উদ্দেশ্য যে, আমাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেওয়া। কে না আঘাত পেয়েছে, বলুন? সেটাও হয়তো পরিকল্পিত ছিল। মনে হয়, কোনো কিছুতেই এই হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে না। নিজেদের অরক্ষিত মনে হয়। আমরা অসহায় বোধ করি। গণহত্যা যেন এক প্রদর্শনী।
আমি আর ছবিগুলো দেখতে পারছি না।
সারি সারি ছোট ছোট কাফনে জড়ানো দেহ। শিরশ্ছেদ করা নারী ও পুরুষ। নিজেদের তাঁবুতে জীবন্ত দগ্ধ পরিবারগুলো। অঙ্গ হারানো বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত শিশুরা। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে টেনে বের করা মরদেহগুলোর ফ্যাকাসে মুখাবয়ব। শোকের আর্তনাদ। শীর্ণ মুখ। আমি আর পারছি না।
এই গণহত্যা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। এটি সুনামির শক্তিতে ইতিহাসের পাতায় প্রতিধ্বনিত হবে। এটি আমাদের চিরতরে বিভক্ত করে দেবে। ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই।
আর কীভাবে আমরা মনে রাখব? মনে না রাখার মাধ্যমেই।
একবার এই ঘটনা শেষ হয়ে গেলে, যারা এটাকে সমর্থন করেছে, যারা এটাকে উপেক্ষা করেছে, যারা কিছুই করেনি–তারা সবাই ইতিহাসকে নতুন করে লিখবে। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসকেও। যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানিতে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল যে, নিজেকে নাৎসি বলে স্বীকার করত। অথবা আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে বর্ণবৈষম্য শেষ হওয়ার পরও নিজেদের কু‑ক্লাক্স‑ক্লানের সদস্য বলে স্বীকার করত কেউ কেউ। এক জাতি নিষ্পাপ। এমনকি ভুক্তভোগীও। এবারও একই হবে। আমরা ভাবতে ভালোবাসি যে, আমরা আনা ফ্রাঙ্ককে বাঁচাতাম। কিন্তু সত্যটা ভিন্ন। সত্য হলো, ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আমাদের প্রায় সবাই কেবল নিজেদেরই বাঁচাব, এমনকি অন্যের ক্ষতি করেও। কিন্তু এই সত্যটা মেনে নেওয়া কঠিন। এটাই হলোকাস্টের আসল শিক্ষা। বরং এটাকে মুছে ফেলাই ভালো।
আপনি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে পারবেন না। ২০ মাস ধরে তাদের বাড়িঘর, গ্রাম ও শহর নিশ্চিহ্ন করতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করতে পারবেন না, হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে পারবেন না, ব্যাপক দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত করতে অবরোধ আরোপ করতে পারবেন না, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে ভূমিতে তারা বসবাস করেছে, সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে পারবেন না এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়া আশা করবেন না। গণহত্যা শেষ হবে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুরু হবে। যদি আপনি মনে করেন যে তা হবে না, তাহলে আপনি মানব প্রকৃতি বা ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওয়াশিংটনে দুই ইসরায়েলি কূটনীতিকের হত্যাকাণ্ড এবং কলোরাডোর বোল্ডারে একটি বিক্ষোভে ইসরায়েলের সমর্থকদের ওপর হামলা কেবল শুরু মাত্র।
চাইম এঙ্গেল। তিনি পোল্যান্ডে নাৎসিদের সোবিবোর ডেথ ক্যাম্পে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি একটি ছুরি দিয়ে ক্যাম্পের একজন প্রহরীকে আক্রমণ করেছিলেন। বহু বছর পর চাইম এঙ্গেল ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘এটা কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। আপনি শুধু প্রতিক্রিয়া দেখান, প্রবৃত্তিগতভাবেই আপনি সেটার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখান, এবং আমি ভেবেছিলাম, ‘আমাদের এটা করতে দাও, এবং যাও, গিয়ে কর।’ আর আমি গেলাম। আমি সেই লোকটির সাথে অফিসে গেলাম এবং আমরা এই জার্মানকে হত্যা করলাম। প্রতিটি খোঁচায় আমি বলছিলাম, ‘এটা আমার বাবার জন্য, আমার মায়ের জন্য, এই সব মানুষের জন্য, তোমরা যে সমস্ত ইহুদিদের হত্যা করেছ তাদের জন্য’।”
কেউ কি ফিলিস্তিনিদের ভিন্নভাবে কাজ করার আশা করে? যখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র, যারা নিজেদের সভ্যতার অগ্রদূত হিসেবে তুলে ধরে এবং তারা এমন একটি গণহত্যার সমর্থন করেছে, যা তাদের বাবা-মা, তাদের সন্তান, তাদের সম্প্রদায়কে হত্যা করেছে, তাদের ভূমি দখল করেছে এবং তাদের শহর ও বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে–তখন তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? যারা তাদের প্রতি এমন করেছে, তাদের ঘৃণা না করে তারা কীভাবে পারবে?
এই গণহত্যা কেবল ফিলিস্তিনিদের কাছে নয়, বরং গ্লোবাল সাউথের কাছে কী বার্তা দিচ্ছে?
এটি দ্ব্যর্থহীন যে, আপনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। মানবিক আইন আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আপনার কষ্ট, আপনার সন্তানদের হত্যায় আমরা পরোয়া করি না। আপনি কীট। আপনি মূল্যহীন। আপনাকে হত্যা করা, অনাহারে রাখা এবং বঞ্চিত করা উচিত। আপনাকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলা উচিত।
আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি, যাদের সাথে বছরের পর বছর ধরে পরিচয় থাকলেও আর কখনো কথা বলব না। তারা জানে কী ঘটছে। কে না জানে? তারা তাদের সহকর্মীদের বিচ্ছিন্ন করার, ইহুদি-বিদ্বেষী হিসেবে কলঙ্কিত হওয়ার, নিজেদের অবস্থান ঝুঁকিতে ফেলার, তিরস্কৃত হওয়ার বা চাকরি হারানোর ভয় পায়। ফিলিস্তিনিদের মতো তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নেয় না। তারা তাদের অবস্থান ও সম্পদের সেইসব করুণ স্মারক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নেয়, যা তারা সারা জীবন ধরে তৈরি করেছে।
আর এইসব স্মারকের পদতলে পড়ে আছে হাজার হাজার নিহত ফিলিস্তিনি।
ক্রিস হেজেস: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাবেক সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য ব্যুরো প্রধান।
(লেখাটি কাউন্টারপাঞ্চ ডট অর্গ-এ প্রকাশিত এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত)