কুমিল্লার মুরাদনগরের এক হিন্দু নারী–তাঁর শরীর, আত্মা ও সম্মান–সবকিছু যেন এ রাষ্ট্র, এ সমাজ, এ সভ্যতার কাছে একবারে অপ্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ, সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া–সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি অপরাধের ঘটনাই নয়, এটি একটি জাতিগত ও রাষ্ট্রীয় লজ্জার পরিণতি। এই লজ্জা আমাদের বিবেককে পুড়িয়ে দেয়, অথচ প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজ যেন নির্বিকার।
একজন নারী তাঁর সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন–এই সাধারণ, নিরীহ সিদ্ধান্তের ফল কী হতে পারে, তা তিনি জানতেন না। ২৬ জুন রাতে দরজা ভেঙে এক যুবক তাঁর ঘরে ঢুকে পড়ে, তাঁকে ধর্ষণ করে। পরে লোকজন আসে তাঁকে ‘উদ্ধার’ করতে। কিন্তু যারা এল, তাদের কেউ কেউ তাঁকে বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও করে। তারপর সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। চিৎকার করা সেই নারীর পাশে দাঁড়ানোর বদলে তাঁকে আরও অপমানের খাদে ঠেলে দেওয়া হয়।
এই নারী চিৎকার করেছিলেন। সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু যারা উপস্থিত ছিল, তাদের কেউ কেউ সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিডিও ধারণ করলেন। এমন নিষ্ঠুর, বিকৃত আচরণ কেবল অপরাধ নয়–এটি একধরনের সামাজিক বিকার, যা আমাদের সম্মিলিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আরও ভয়ঙ্কর সত্য হলো–এমন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেও চারদিক প্রায় স্তব্ধ। না কোনো রাজনৈতিক তোলপাড়, না কোনো সামাজিক আন্দোলনের ঢেউ। গণমাধ্যমও যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি, যেন সংখ্যালঘু নারীর ধর্ষণ এখন আর ‘সংবাদ’ নয়, বরং ক্লিকবেইট ছাড়া আর কিছু নয়। এ দেশে সাংবাদিকতা এখন সত্যের মুখ নয়–‘ব্যবস্থার সহায়ক শিল্প’। এই ভিডিও দেখে তাদের বিবমিষা জন্মায় না, কণ্ঠরোধ হয় না ধর্ষিত নারীর আর্তনাদে–তারা যেন দেখতে পায় শুধু এক ‘সংখ্যালঘু নারী’, তাই তাঁর যন্ত্রণাও ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন উঠবেই–এই ধর্ষণ যদি সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বী কোনো নারীর ওপর ঘটত? যদি সেই ভিডিওর ভুক্তভোগী হতেন কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য? তবে কি মিডিয়া এমন চুপ থাকত? তবে কি প্রশাসন এমন নিশ্চুপ থাকত? তবে কি রাষ্ট্র তার ঘুমোচোখে তাকিয়ে থাকত?
এই সমাজ কী করছে? কোথায় সেই নাগরিক সমাজের চিৎকার? কোথায় সেই প্রতিবাদ, সেই বিক্ষোভ, সেই সোচ্চার জনতা? যে ভিডিওর প্রতিটি দৃশ্য ঘৃণায় চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য করে, তা কয়েক সেকেন্ডেও মানুষকে অসুস্থ করে দেয়–সে ভিডিও মানুষ দেখছে, শেয়ার করছে, আলোচনা করছে; কিন্তু প্রতিবাদ করছে না।
এই নীরবতা আর নির্বিকারতাই ধর্ষকদের সাহস দেয়। রাষ্ট্র যখন চুপ, সমাজ যখন ঘুমিয়ে, রাজনীতি যখন নিজ নিজ হিসাব নিয়ে ব্যস্ত–তখনই জন্ম নেয় মুরাদনগরের মতো ঘটনা।
এই অপরাধীরা খুব ভালো করেই জানে–এই দেশে বিচার দীর্ঘসূত্রতা নয়, বরং অনিবার্য বিলম্ব। তারা জানে, তথ্যপ্রমাণ কোথায় গেলে হারিয়ে যায়, কোন থানায় গেলে জিডি নেয় না, কোন ডাক্তার ‘রিপোর্ট ক্লিয়ার’ লিখে দেয়। তারা জানে, রাজনীতির ছায়া কেমন করে নৃশংস অপরাধীদের গায়ে গোপনে বিজয়ীর মালা পরিয়ে দেয়। এ রাষ্ট্রের আইন যেন কেবল দুর্বলদের জন্য, আর ক্ষমতাবানদের জন্য এক অলিখিত ছাড়পত্র।
তাই তারা ভয় পায় না–বরং আরও সাহস পায়। সাহস পায় ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করতে, সাহস পায় ভিডিও ছড়িয়ে দিতে, সাহস পায় নারীর শরীর, আত্মা ও সম্মানকে জনসমক্ষে টেনে এনে ধূলিসাৎ করতে।
গত এক বছর ধরে রাষ্ট্র যেভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে, তাতে নারীর নিরাপত্তা, অংশগ্রহণ ও স্বীকৃতি–তিনটিই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এক ভয়াবহ নিঃশব্দ নির্মূল প্রক্রিয়া চলছে। যেসব নারী অতীতে আন্দোলনের সম্মুখভাগে ছিলেন, যাদের কণ্ঠ ছিল প্রখর ও প্রতিবাদী–তাদের এখন একে একে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে–ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, নীতিনির্ধারণের টেবিল থেকে, এমনকি সামাজিক পরিসর থেকেও।
এখন তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চলছে–বাসে, ট্রেনে, রাস্তায়, ক্যাম্পাসে, অফিসে। তাদের স্পষ্ট করে চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের কণ্ঠকে ‘অশোভন’, ‘উসকানিমূলক’, কিংবা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।
একটি ‘নারী সংস্কার কমিশন’ গঠিত হয়েছে–শুনতে যতটা প্রগতিশীল, বাস্তবে ততটাই প্রতারক। সেই কমিশনের কোনো সুপারিশ নিয়ে রাষ্ট্রে নেই কোনো আলোচনা, নেই কোনো নীতিগত প্রতিফলন। বরং একদল ধর্মীয় গোঁড়া ও নারীবিরোধী চক্র প্রকাশ্যে সেই কমিশনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে–আর রাষ্ট্র সেই বিষাক্ত চিৎকারের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কোথায় রাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান? কোথায় নারীর পক্ষে ক্ষমতার সোচ্চার উচ্চারণ?
নেই–কারণ রাষ্ট্র আজও জানে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নারীর কণ্ঠ নয়, পুরুষতন্ত্রের চিৎকারই অধিক কার্যকর।
যে দেশে ধর্ষকের গলায় ফুলের মালা, আর ধর্ষিতার শরীরে ক্ষতের দাগ–সেই দেশে ন্যায়বিচার শব্দটা একটা ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু নয়। চট্টগ্রামে আন্দোলনকারী এক নারীকে পুলিশ সদস্য কোমরে লাথি মারে–এটা ক্যামেরাবন্দী হয়, সবার চোখের সামনে আসে। কিন্তু সেই হামলাকারীকে মাত্র দুদিনের মাথায় জামিন দেওয়া হয়, আর থানা থেকে বেরোনোর সময় তার গলায় পরানো হয় ফুলের মালা। রাষ্ট্র যেন ঘোষণা করছে–আমরা অপরাধের পক্ষে, আমরা নির্যাতনের পক্ষেই দাঁড়াই।
এভাবে বিচারব্যবস্থার নামে যখন অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া হয়, তখন তা কেবল অপরাধীকেই উৎসাহিত করে না–সমাজকে আরও নষ্ট, আরও বিকৃত করে তোলে।
এখন আর সময় নেই নিঃশব্দ ক্ষোভ বা শুদ্ধতামূলক নিন্দার। এখন সময় সংগঠিত প্রতিরোধের। সময় এসেছে এই পচনধরা সমাজ ও রাষ্ট্রের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার। সময় এসেছে রাজপথে জবাব চাইবার, দখল নেওয়ার। আমাদের আন্দোলনের দাবিগুলোও হতে হবে আগুনের মতো জ্বলন্ত, স্পষ্ট ও অনড়:
১. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রত্যেক ঘটনায় দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; ২. ভিডিও ধারণকারী ও ছড়ানোকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা; ৩. ‘উদ্ধারের নামে’ নারীর ওপর দ্বিতীয় দফা নির্যাতন–এর জন্য পৃথক আইন ও শাস্তির বিধান; ৪. সংখ্যালঘু নারীদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ; ৫. নারীর প্রতি সহিংসতায় যুক্ত প্রত্যেক অপরাধীর পরিচয় ও ছবি প্রকাশের বাধ্যবাধকতা
এখন আর মুখ লুকিয়ে কান্নার সময় নয়। এখন চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর সময়–সংঘবদ্ধভাবে, সংগঠিতভাবে, প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়। একটি সমাজে অপরাধ হঠাৎ করে জন্মায় না; বরং জন্ম নেয় রাষ্ট্র ও সমাজের নীরবতা থেকে, বিচারহীনতার প্রশ্রয়ে। অপরাধীরা প্রথমে দেখে, শিখে নেয়–এখানে ধর্ষণ করলেও শাস্তি হয় না, ভিডিও ছড়ালেও কেউ প্রতিহত করে না। তারপর তারা সংগঠিত হয়, আত্মবিশ্বাসী হয়, এবং শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া হয়।
মুরাদনগরের ঘটনাও ঠিক তেমনই এক নির্লজ্জ আত্মবিশ্বাসের ফসল। সেই অপরাধী জানত–এই রাষ্ট্র ঘুমায়, এই সমাজ চুপ থাকে, এই আইন চোখ বন্ধ রাখে। তাই সে একা ছিল না, তার পাশে ছিল আমাদের ব্যর্থতা।
এই ঘটনা কেবল একজন নারীর ওপর বর্বরতার নয়, এটি পুরো সমাজের ওপর এক ঘৃণ্য চাবুক। আর সেই চাবুকের ঘায়ে আমরা সবাই আহত–কারও মা, কারও বোন, কারও সহকর্মী হয়তো আজ নিরাপদ; কিন্তু আগামীকাল?
এই সমাজে কেউ নিরাপদ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা একত্র না হই। এ দায় কারও একার নয়। রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম, এবং আমরাও–এই ব্যর্থতার দায়ে সমানভাবে অভিযুক্ত।
ধিক সেই সমাজকে, যে নির্যাতনের ভিডিও করে শেয়ার করে কিন্তু রুখে দাঁড়ায় না। ধিক সেই রাষ্ট্রকে, যে নারীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ধিক সেই ক্ষমতাকে, যে ধর্ষকের সামনে মাথা নত করে।
আরও একটি ঘটনা ঘটার আগে, আরও একটি ভিডিও ছড়ানোর আগে, আরও একটি জীবন আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদের দাঁড়াতেই হবে–প্রতিরোধে, প্রতিবাদে, পুনর্গঠনে। নইলে কাল যাকে আমরা বাঁচাতে পারব না, সে হতে পারে আমাদের মা, আমাদের বোন, আমাদের সন্তান–বা আমরা নিজেরাই।
এখনই সময়–জেগে ওঠার। নইলে ইতিহাস আমাদের কখনও ক্ষমা করবে না।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]