এক বা দেড় দশক আগেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অভিবাসীদের কাছে কানাডা অন্যতম প্রধান লক্ষ্যস্থল হিসাবে বিবেচিত হতো, যদিও এটি শীতপ্রধান একটি দেশ। বর্তমানে কানাডা অভিবাসীদের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে?
অভিবাসনের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আকর্ষণীয় করে তুলতে অভিবাসীদের কাছে দেশটি যে বসবাসের জন্য কত নিরাপদ, জনগণের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা কত উন্নত, নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ কত উন্নত হবে, কম খরচে কীরকম উন্নতমানের জীবন নির্বাহ করা সম্ভব, এ জাতীয় কল্পিতচিত্র পরিবেশন করার কাজও কানাডা সরকারকে করতে হচ্ছে। আদতে বাস্তবতা কী বলে তার একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক।
অতিসম্প্রতি জাতিসংঘ, কানাডা সরকার, আমেরিকার সরকার ও কানাডার সিবিসি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু তথ্য হাতে এসেছে। বিগত ১০ বছরের সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালের দশ বছর পর গত ২০২২ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক কানাডিয়ান নাগরিক নিজ দেশ ত্যাগ করে দক্ষিণের দেশ আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। যদিও এই প্রবণতাটি একবারে নতুন কিছু নয়। কানাডা থেকে নিয়মিতভাবেই কিছুসংখ্যক নাগরিক আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে যান। কারণ এক/এগারোর আগে কানাডিয়ান নাগরিকেরা ভিসা ছাড়াই আমেরিকায় যেতে ও বসবাস করতে পারতেন। তবে এখন আর তা পারেন না। ছয় মাসের অধিককালের জন্য এখন চাকরি, বিনিয়োগ, পড়াশোনা, কাজ কিংবা বসবাসে সে দেশে স্থায়ীভাবে থাকার আবেদন বা ভিসার প্রয়োজন আছে।
তবে আমেরিকার জনসংখ্যা ব্যুরোর অধীন আমেরিকান কম্যুনিটি সার্ভের প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক তথ্যে জানা গেছে, ২০১২ সালের পর ও কোভিড উপদ্রুত বছরগুলোর পর ২০২২ সালে দেশত্যাগের সেই হার আগের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে! ২০১২ সালের চেয়ে ২০২২ সালে কানাডা থেকে স্থায়ী দেশত্যাগের অঙ্ক ৭০ শতাংশেরও অধিক! ২০১২ সালের দেশত্যাগী কানাডিয়ানদের সংখ্যা ছিল ৭৬ হাজারের মতন এবং ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি।
জাতিসংঘের এক তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে আমেরিকা যেখানে এক লাখ কানাডিয়ান নাগরিক স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে গেছেন, একই বছরে সেখানে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে গেছে আট লাখ কানাডিয়ান নাগরিক!
দেখা যাক, কেন কানাডিয়ার নাগরিকেরা নিজের এত ভালো দেশ ত্যাগ করে দক্ষিণের দেশ আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে যায়। কারণ হিসেবে অনেকগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, এদেশে ইউরোপিয়ান অভিবাসীদের প্রচলিত চিরায়ত মূল্যবোধ পরিবর্তিত বা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া, প্রেম বা বিয়ে, কাজ বা চাকরিতে আমেরিকার চেয়ে নিম্নহারে মজুরি, অযৌক্তিকভাবে অত্যধিক বাড়িভাড়া ও বাড়ির মূল্য এবং ভালো আবহাওয়ার কথাগুলোই প্রধান।
অনেকেই এর সঙ্গে কানাডার মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক দুরাবস্থার কথাও যোগ করে থাকেন। তবে অনেকেই খুব স্পষ্টভাবে কানাডার বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ও আর্থিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার প্রতি ইঙ্গিত করেন। অনেকেই সরাসরি পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ত্রুটির সমালোচনা করেন। তাদের বক্তব্য এরকম যে, তাঁর নেতৃত্বে জাতি হিসেবে কানাডার চিরাচরিত পরিচতি বা মূল্যবোধ বদল বা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আরো মনে করেন, শুধুমাত্র ভোটব্যাংকের রাজনীতির জন্য কানাডার ভবিষ্যৎ ভুল পথে এগোচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কষ্টার্জিত ট্যাক্স দেওয়া নাগরিকদের স্বার্থ সমাধানে মনোযোগ না দিয়ে ভোট বাক্সের দিকে তাকিয়ে ভুল নীতি ও ভুল পদক্ষেপ নিতে ব্যস্ত থাকেন। যা রাষ্ট্র হিসাবে কানাডার পরিচিতি ও বিশেষত্ব বিনষ্ট করছে।
আমেরিকা-কানাডার জীবনযাপন তুলনাতে দেখা যায়, আমেরিকার কোনো কোনো রাজ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় কানাডার তুলনায় বেশি হলেও বাড়ির দাম কানাডার তুলনায় ঢের (২০% থেকে ৩০%) কম। অন্যদিকে কিছু কিছু রাজ্যে স্বাস্থ্যবীমা ও চিকিৎসা খরচ কানাডার তুলনায় বেশি। তা সত্ত্বেও কানাডার মানুষের দক্ষিণযাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে!
এসব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জন্মসূত্রে কানাডিয়ান ৪২% ও জন্মসূত্রে আমেরিকান ৩৪% (যারা বিভিন্ন কারণে তাদের আদি বাসভূমি ছেড়ে এসেছিলেন) কানাডা ত্যাগ করে দক্ষিণে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বাকি ২৪% যারা আমেরিকায় গেছেন, তারা কানাডার বাইরে জন্ম নেওয়া কানাডিয়ান।
জানা গেছে, কোভিড পূর্ব সময়ে এত অধিক সংখ্যায় নাগরিক কানাডা ছেড়ে চলে যায়নি। আর এ কারণে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে! আবার নবাগত অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এর বাইরে আরো কিছু চিত্র রয়ে গেছে।
কানাডার সরকারি তথ্য মোতাবেক, নবাগত অভিবাসীদের ১৫%-এর অধিক অভিবাসী কানাডা আগমনের বছর কয়েকের মধ্যেই হয় নিজদেশে ফিরে যায় বা আমেরিকা কিংবা অন্য কোন দেশে চলে যায়। এদের একটি অংশ আরও স্বল্প সময়ের মধ্যেই কানাডা থেকে ফিরে যায়। খাতাকলমের এ সমস্ত হিসেবের বাইরে, কানাডা থেকে আরেকটি জনসমষ্টি অংশ নিয়মিত আমেরিকায় প্রবেশ করে।
বিপরীতে আমেরিকা থেকেও, সেখানে ঠায় করতে না পেরে, বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে কানাডাতে প্রবেশ করে। সংখ্যায় তা যে খুব কম তা নয়। বার্ষিক সংখ্যাটি এক লাখের উপর–নিচে। তা হলো কানাডা থেকে আমেরিকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ। কানাডা সরকারিভাবে এই তথ্য, স্বীকার না করলেও, কাজটি সরকারের চোখের সামনে ঘটে।
এই আমেরিকা অভিমুখী কানাডাবাসীকে সহায়তার প্রয়োজনে আবার নানাবিধ আয়োজনও জোগাড় হয়ে আছে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে। এ কাজে সহায়তার জন্য তৈরি হয়েছে উকিলশ্রেণি, তাদের জন্য রয়েছে কর্মী নিয়োগ সংস্থা, আছে বাড়ি কেনা-বেচা বা বাড়িভাড়া এজেন্সি বা দালাল চক্র। কানাডার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে যেয়ে স্থায়ী আবাস ও অফিস খুলে বসে গেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কানাডা থেকে আমেরিকা অভিমুখী দেশত্যাগের এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান! যে ঘাটতি পূরণে কানাডা সরকারের লক্ষ্য আর অধিকসংখ্যক অভিবাসী আসার সুযোগ সৃষ্টি করা। তবে যে আর্থিক ও রাজনৈতিক মন্দার কবলে কানাডা পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের আশংকা, তাতে আগামী নির্বাচনে যে দলের সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বর্তমান সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে গৃহীত অভিবাসী গ্রহনের ক্ষেত্রে সংকোচন নীতিমালা বদল হওয়া বা বদলানোর আশু সম্ভাবনা নেই।