মঙ্গল গ্রহ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এই লাল গ্রহটিকে জয় করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও আছে মানুষের। স্পেসএক্সের স্বত্বাধিকারী ইলন মাস্ক মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন আরও আগেই। এবারে চীনের বিশেষজ্ঞরা চাঞ্চল্যকর এক উদ্ভাবনী পরিকল্পনার কথা জানালেন, যেটার বাস্তব রুপ দেওয়া গেলে মানুষের মঙ্গল অভিযানে যুগান্তকারী অগ্রগতি দেখা যেতে পারে।
সম্প্রতি (৭ জুন) চীনা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মঙ্গল গ্রহের নিজস্ব বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস থেকেই তৈরি করা যাবে টেকসই এনার্জি ও রিসোর্স সিস্টেম। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে মঙ্গল অভিযানে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন এনার্জি ও রিসোর্স যেমন অক্সিজেন, মিথেন ইত্যাদি মঙ্গল গ্রহে প্রাপ্ত গ্যাস থেকেই উৎপাদন করা যাবে। এর ফলে পৃথিবী থেকে সরবরাহের পরিবর্তে এই শক্তি ও সম্পদের (রিসোর্সের) সংস্থান হয়ে যাবে মঙ্গলেই।
আর এভাবেই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রাপ্ত গ্যাসের সাহায্যে নতুন-প্রজন্মের মহাকাশ শক্তি ব্যবস্থা (ডিপ স্পেস এনার্জি সিস্টেম) গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন চীনের গবেষকরা। তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তব রুপ নিলে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে আরও কিছুটা এগিয়ে যাবে মানুষ।
চীনের গবেষকরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাসকে শক্তি ও সম্পদ (এনার্জি এন্ড রিসোর্সেস) হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শক্তি সঞ্চয় (এনার্জি স্টোরেজ), হিটিং, অক্সিজেন ও মিথেন (ফুয়েল বা জ্বালানী) উৎপাদন করা যাবে মঙ্গলে প্রাপ্ত গ্যাস থেকেই। সার্বিকভাবে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশ ব্যবহার করেই একটি সমন্বিত শক্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে থাকা গ্যাসের সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছেন চীনের বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণস্বরুপ, মঙ্গলপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সব সময় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বিরাজ করে এই লাল গ্রহটিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে উৎপন্ন নিম্ন-তাপমাত্রার প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাপকে (ওয়েস্ট হিট) মঙ্গল গ্রহের গবেষণা স্টেশনগুলোর আভ্যন্তরীণ উষ্ণতা বজায় রাখতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অর্থাৎ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে নিম্ন-তাপমাত্রার যে তাপ পাওয়া যাবে সেটাকে নষ্ট না করে গবেষণা স্টেশনে প্রয়োজনীয় তাপ শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এছাড়া মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিথেন ও অক্সিজেন উৎপাদনও সম্ভব বলে জানিয়েছেন চীনা গবেষকরা। মধ্যম-তাপমাত্রায় গ্রহটির গ্যাসকে, বিশেষ করে কার্বন ডাই অক্সাইডকে মিথেন উৎপাদনে ‘প্রতিক্রিয়া গ্যাস’ (রিঅ্যাকশন গ্যাস) হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি মঙ্গলের গ্যাসে বিদ্যমান উচ্চ-তাপমাত্রার উপাদান ব্যবহার করে অক্সিজেন উৎপাদনও সম্ভব। এক্ষেত্রে গ্রহটির গ্যাস উচ্চ-তাপমাত্রার ইলেকট্রোলাইসিস হিসেবে কাজ করবে।
এই প্রক্রিয়ায় মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাসে বিদ্যমান পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বন ও অক্সিজেনের অণুকে মূল্যবান অক্সিজেন ও মিথেন গ্যাসে রুপান্তর করা সম্ভব হবে। এর ফলে নভোচারীরা মঙ্গল গ্রহ থেকেই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পেয়ে যাবেন, পৃথিবী থেকে নিয়মিতভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে না। পাশাপাশি মঙ্গলে উৎপাদিত মিথেন গ্যাসকে মহাকাশযানের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
অর্থাৎ সার্বিকভাবে মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধানী অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে চীনা গবেষকদের উদ্ভাবনী এই আইডিয়া।
তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অফ চায়নার গবেষক শি লিংফেং। তিনি বলেছেন, মঙ্গল গ্রহে গবেষণা চালাতে হলে সেখানে প্রচুর পরিমাণ সনাক্তকরণ সরঞ্জাম ও গবেষণা স্টেশন স্থাপন করতে হবে। আর এই সনাক্তকরণ সরঞ্জাম ও গবেষণা স্টেশন সচল রাখার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত শক্তি (এনার্জি) ও সম্পদের (রিসোর্সেস)।
লিংফেং আরও বলেন, মঙ্গলে একটি টেকসই শক্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই গ্রহটির বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশের কথা বিবেচনায় আনতে হবে। অর্থাৎ মঙ্গলের স্থানীয় পরিবেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন সলিউশন নিয়ে আসতে হবে। তিনি মনে করেন যে, এই গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছুর সূচনা হয়েছে ঠিকই, তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স