এ যেন রীতিই হয়ে গেছে! টি-টোয়েন্টি থেকে বাংলাদেশের সিনিয়র কোনো ক্রিকেটারের বিদায় কখনোই একেবারে ঘটা করে আয়োজন করে হবে না।
মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দিয়ে শুরু। এরপর তামিম ইকবাল বলুন, মুশফিকুর রহিমই হোন বা সাকিব আল হাসান – কারওই একেবারে সাড়ম্বরে বিদায় নেওয়া হয়নি। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না।
দিল্লিতে আজ বাংলাদেশের জার্সিটা টি-টোয়েন্টিতে আর না পরার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এর মধ্য দিয়ে টি-টোয়েন্টিতে শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের ‘পঞ্চপান্ডব’ যুগ। এই তো শেষ! মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ – বাংলাদেশের ক্রিকেট রাঙিয়ে যাওয়া গত এক দশকের কেন্দ্রে যে পাঁচজন, তাঁদের কাউকেই আর বাংলাদেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে দেখা যাচ্ছে না।
কতটা রঙিন ছিল পঞ্চপান্ডবে ধন্য সে অধ্যায়? পর্যালোচনায় একটা অদৃশ্য সুতো না চাইলেও চোখের সামনে এসে পড়ে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুব একটা সুখকর নয় সুতোটা। পাঁচজনের শুরুটা যতটা সুখকর ছিল, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বিষাদময় ছিল তাদের বিদায়ের ক্ষণ। বিদায়ে দীর্ঘশ্বাস তো ঝরেছে, কিন্তু ‘আর কটা দিন থেকে গেলে কী হতো’ আক্ষেপটা কী কজনের ক্ষেত্রেই-বা আর থেকেছে?
পেছনে তাকিয়ে একে একে বিদায়ের ক্ষণগুলোতে ফেরা যাক। শুরুটা মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দিয়ে ২০১৭ সালে। অকস্মাত বজ্রপাত হয়ে এসেছিল তাঁর অবসরের ঘোষণা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোয় প্রথম টি-টোয়েন্টির আগে হঠাৎ টসের সময় মাশরাফি জানিয়ে দেন, এই ফরম্যাট থেকে অবসরে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৭ সালে সেবার মাশরাফি এমন আচমকা সরে দাঁড়ানোর কথা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল।
২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক মাশরাফির, এরপর ৫৪ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ৪২টি, ব্যাটিংয়ে ১৩৬ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ৩৭৭ রান।
তামিম ইকবালের বিদায়ের ধরনটাও কি মাশরাফির চেয়ে খুব ভিন্ন ছিল? ২০২২ সালে আচমকা এক রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তামিম জানিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টিতে আর নয়! অথচ বিষাদ ছড়িয়ে যাওয়া রাতের আগের দিনের বেলাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আনন্দেরই তো ছিল! ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্রই ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ, তামিমেরই নেতৃত্বে। বাংলাদেশের মানুষ যখন মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বালিশে মাথা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, হাসিটা মিলিয়ে গেল তামিমের এক স্ট্যাটাসে।
টি-টোয়েন্টিতে কেমন করেছেন তামিম? পরিসংখ্যান বলবে, ২০০৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে অভিষিক্ত তামিম ৭৮ ম্যাচে রান করেছেন ১৭৫৮টি। ২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের শেষ টি-টোয়েন্টি খেলা তামিমই এখনো টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান।
তামিমের পর একই বছরের সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপ শেষে টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানিয়ে দেন মুশফিকুর রহিম। মাধ্যম? সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস! সেবার এশিয়া কাপটা হয়েছিল টি-টোয়েন্টি সংস্করণে, সেই টুর্নামেন্টকেই টি-টোয়েন্টিতে নিজের শেষ জানিয়ে সরে গেলেন মুশফিক। অভিমান নিয়েই কি গেলেন? মুশফিকের উচ্চারণে যদিও বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে মনোযোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর মনে জমে থাকা অভিমান কীভাবে যেন অনুচ্চারিত থেকেও ক্রিকেটপ্রেমী শত কোটি কানজোড়ায় ধ্বনিত হয়ে গেল! ১০২টি টি-টোয়েন্টির অভিজ্ঞ মুশফিক ১১৫ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ১৫০০ রান।
মাশরাফি তবু মাঠ থেকে অবসর নিয়েছিলেন, এরপর তামিম-মুশফিকের মতো মাঠে থেকেই অবসরের ঘোষণা দেওয়া হয়নি সাকিব আল হাসানেরও। এই ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেই কানপুরে দ্বিতীয় টেস্ট খেলার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে সাকিব জানিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষেই ম্যাচটাই ছিল এই সংস্করণে তাঁর শেষ। দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সেরা পারফরমারের কী বেমানান বিদায়! ১২৯ টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের রান ২৫৫১, উইকেট ১৪৯টি।
আর বাকি ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশ কতটা দু-চার বছর পরের বিশ্বকাপ মাথায় রেখে পরিকল্পনা করে দল সাজায়, সে নিয়ে ক্রিকেটপাড়ায় প্রশ্ন আছে অনেক, তবে দুই বছর পরের আরেক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বর্তমানে ৩৮ পেরোনো রিয়াদকে দেখার সম্ভাবনা যে ক্ষীণ, সেটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। অত বোঝাপড়ার দরকারও পড়ল না।
বাকি চারজনের মতো রিয়াদও আচমকা সরে দাঁড়ানোর কথা জানালেও তাঁর ভক্তরা অন্তত একটা ব্যাপারে স্বস্তি খুঁজে নিতে পারেন। বিদায়ের আগের অন্তত ভারতের বিপক্ষে এই সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে রিয়াদকে টি-টোয়েন্টিতে শেষবার দেখে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছে!