শুধু স্কোরবোর্ডে তাকালে আম্পায়াররা ‘স্টাম্পস’ ডাকার পরের দৃশ্যটাকে অদ্ভুত লাগতে পারে। দিন শেষে ভারতের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান – শেষ দুই ব্যাটসম্যান যশপ্রীত বুমরা আর আকাশদীপ হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়ছিলেন। তেমন কিছুই না পেলেও সব না হারানোর তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারেন তাঁদের হাসিতে। আর অস্ট্রেলিয়ার এগারো জনের মুখে হাসি নেই।
অথচ স্কোরবোর্ড বলবে, ব্রিসবেনে আজ বৃষ্টিবিঘ্নিত চতুর্থ দিনের শেষে ভারতের ওপরই ছড়ি ঘোরাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
প্রথম দিনে ১৪ ওভারও না দেখা টেস্টটিতে দ্বিতীয় দিনে যা কিছু ক্রিকেট হয়েছে, গতকাল তৃতীয় দিনে আবার বৃষ্টির বাধায় খেলা হতে পেরেছে মাত্র ৩৪ ওভারের মতো। আজ বৃষ্টি বাগড়া দিলেও গতকালের তুলনায় ক্রিকেটের দেখা কিছুটা বেশিই মিলেছে – পুরো দিনে খেলা হয়েছে ৫৮ ওভারের মতো। দিন শেষের অবস্থা, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৪৪৫ রানের জবাবে ভারত আজ চতুর্থ দিন শেষ করেছে ৯ উইকেটে ২৫২ রান নিয়ে। এখনো ১৯৩ রানে পিছিয়ে ভারত।
তবু ভারতের ক্রিকেটাররা হাসতে পারছেন, কারণ দুটি - ভারতকে ফলো-অন করাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। শেষ পর্যন্ত দিনের শেষ বনে যাওয়া ওভারটির দ্বিতীয় বলে কামিন্সকে চার মেরে সেটি নিশ্চিত করেছেন আকাশ দীপ। তাতেই তো সব হিসাব পাল্টে গেল! ফলো অনের লজ্জায় পড়তে হয়নি, তবে ম্যাচের সমীকরণে তাকিয়ে সেটিকে গৌণই মানতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় কারণটি প্রথম কারণটির ‘বাই-প্রোডাক্ট।’ ভারতকে ফলো অন করাতে পারলে অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনা তো একেবারে জলের মতো সহজ হয়ে যেত – আগামীকাল পঞ্চম দিনে জয়ের জন্য সব নিয়ে ঝাঁপানো। কিন্তু ভারত ফলো অন এড়িয়ে ফেলায় ঝামেলাটা কী হলো?
এই টেস্টে আর দিন বাকি একটি, সেটিতেও বৃষ্টির হানা দেওয়ার সম্ভাবনা। ফলো অন করাতে না পারায় অস্ট্রেলিয়াকে এখন আরেকবার ব্যাটিংয়ে নামতে হবে, ওদিকে রানের ব্যবধান ২০০-র নিচে নেমে আসায় অস্ট্রেলিয়া এখন চাইলেও হেলায় ইনিংস ঘোষণা করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না। অন্তত ১০০-১৫০ রান তুলতেই চাইবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সে রান তুলতে যতটা সময় পেরিয়ে যাবে, তারওপর বৃষ্টিও যদি বারেবারে বাধার তৈরি করে, সে ক্ষেত্রে এই টেস্টে ভারতের হারের শঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে।
দিন শেষে তাই ভারতের ওপরই অস্ট্রেলিয়া ছড়ি ঘোরালেও ভারতেরই ক্রিকেটারদের খুশি না হওয়ার কারণ তো নেই।
আজ দিনের শুরুটাই ছিল ভারতের জন্য পয়মন্ত। দিনের একেবারে প্রথম বলেই লোকেশ রাহুলের ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন স্টিভ স্মিথ। শেষ পর্যন্ত সেই স্মিথেরই দারুণ ক্যাচের শিকার হয়ে রাহুল আউট হলেন বটে, তবে ততক্ষণে লাঞ্চের কাছাকাছি পর্যন্ত সময় গড়িয়ে গেছে। আর ভারতের স্কোরবোর্ডে যোগ হয়েছে ৯০ রান, যার ৫১-ই রাহুলের। আগের দিনের ৩৩ রান নিয়ে দিন শুরু করা রাহুল শেষ পর্যন্ত দিনে দ্বিতীয় ও ভারতের ইনিংসে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন ৮৪ রান করে।
রাহুলের ক্যাচ মিসের কিছুক্ষণ পরই, দিনের সপ্তম ওভারে কামিন্স ফেরান ভারত অধিনায়ক রোহিতকে (১০)। এরপরই ভারতকে ইনিংসে সবচেয়ে ভরসা জোগানো দুই ব্যাটসম্যান একসঙ্গে ক্রিজে সময় কাটিয়েছেন। রাহুল তো ভারতের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেকনিকের দিক থেকে সবচেয়ে গোছানোই ছিলেন, রবীন্দ্র জাদেজাও লড়েছেন দারুণ। ষষ্ঠ উইকেটে দুজনের জুটিতে এসেছে ৬৭ রান।
লাঞ্চের আগে লায়নের বলে স্লিপে স্মিথের হাতেই ক্যাচ দিয়ে রাহুল বিদায় নিলেও জাদেজার লড়াই শেষ হয়নি। নিতিশ কুমার রেড্ডিকে (১৬) নিয়ে সপ্তম উইকেটে ৫৩ রানের জুটিতেই ভারতকে ২০০-র কাছে নিয়ে গেছেন। সে পথে জাদেজার নিজেরও ফিফটি হয়ে গেল।
এরপর অবশ্য আবার ধাক্কা খেয়েছে ভারত। দলের স্কোর ২০০ পেরোতেই সিরাজ (১) বিদায় নিলেন, কিছুক্ষণ পর দলকে ২১৩ রানে রেখে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে গেলেন জাদেজাও। তাঁর ১২৩ বলে ৭৭ রানের ইনিংস যখন শেষ হচ্ছে, ভারতের ফলো-অনকে অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হচ্ছিল।
কিন্তু অবশ্যম্ভাবী হলেও বিধিলিপি তো আর তা ছিল না! দশম উইকেটে কী অসামান্য প্রতিরোধ গড়লেন বুমরা আর আকাশদীপ। গতকালই দিন শেষে গ্যাবার পিচে ব্যাটিং নিয়ে সাংবাদিকের খোঁচা মারা প্রশ্নের জবাবে নিজের ব্যাটিং দক্ষতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বুমরা। পিচে ব্যাটিং কতটা কঠিন প্রশ্নের শুরুটাই সাংবাদিক করেছিলেন ‘যদিও আপনি হয়তো প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যক্তি নন’ বলে, জবাবে সকৌতুক বুমরা তাঁর টেস্টে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান নেওয়ার (স্টুয়ার্ট ব্রডের ওভারে ৩৫ রান) রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই বুমরা অবশ্য আক্রমণ নয়, ঠেকিয়ে ব্যাটিং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শেষ উইকেটে বরং আক্রমণ যা করেছেন আকাশদীপ!
বুমরা ২৭ বলে ১ ছক্কায় করেছেন ১০ রান, শেষ ওভারে কামিন্সের বলে ফলো-অন এড়ানো নিশ্চিত করা চারের পর একটি ছক্কাও হাঁকানো আকাশদীপ ৩১ বলে ২ চার ১ ছক্কায় ২৭ রান নিয়ে ব্যাট করছেন। দুজনের ৫৩ বলের ৩৯ রানের অবিচ্ছিন্ন এই জুটিই কি টেস্টের সব হিসাব পাল্টে দিল?