গত অক্টোবরে বাংলাদেশ দলের কোচের পদ থেকে চান্দিকা হাথুরুসিংহের ছাঁটাই হওয়া নিয়ে নাটক কম হয়নি। নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বিসিবির পক্ষ থেকে প্রথমে হাথুরুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, শ্রীলঙ্কান কোচের কাছ থেকে এর জবাব চাওয়া হয় ১৬ অক্টোবরের মধ্যে। কিন্তু ১৫ অক্টোবরই বাংলাদেশের নতুন কোচ হিসেবে ফিল সিমন্সের নাম ঘোষণা করা হয়।
হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়ে তিনি নাসুম আহমেদকে চড় মেরেছিলেন, যদিও সে অভিযোগ জোরের সঙ্গেই অস্বীকার করেছেন হাথুরুসিংহে। ওদিকে বিসিবির নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক আহমেদ যে হাথুরুকে পছন্দ করেন না, সে তো ‘ওপেন সিক্রেট।’ সে কারণে হাথুরুর বিদায় ঠিক কী কারণে হয়েছে, এ নিয়েও আছে বিতর্ক।
এসবের মধ্যেই অক্টোবরে বাংলাদেশ ছাড়েন হাথুরুসিংহে। সে সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব দেবেন বলে জানিয়েছিলেন।
এসবের এতদিন পর আজ আবার হাথুরুসিংহের কথা সামনে এসেছে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম কোড স্পোর্টসে হাথুরুর আলাপের পর। হাথুরু আরেকবার নাসুমকে চড় মারার কথা অস্বীকার করেছেন জোর দিয়ে, বলেছেন, তিনি পিঠে টোকা দিয়েছিলেন। তাঁর চাকরি যাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই ‘নতুন সভাপতির আগে থেকেই ঠিক করে রাখা’ ব্যাপার বলে জানিয়েছেন। এসব ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠেছে যে কথাটা, তা হলো – হাথুরু জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ ছাড়ার সময়ে তিনি প্রাণ নিয়েই ভয়ে ছিলেন!
বাংলাদেশ ছাড়ার পেছনের গল্পটা হাথুরু জানালেন এভাবে, ‘আমাকে বাংলাদেশের (ক্রিকেট বোর্ডের) সিইওর শেষ কথাটা ছিল এই যে, তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন আমি চলে যাই। “বোর্ডের কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, আপনার কি যাওয়ার টিকিট করা আছে?” আমার কাছে এটা ছিল একটা সতর্কবার্তা। তখনই আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।’
হাথুরুর কণ্ঠে এরপরের ঘটনাক্রম, ‘ওই দেশটাতে ঘোরাঘুরির সময়ে সাধারণত আমাকে একজন ড্রাইভার ও একজন গানম্যান দেওয়া হতো। তিনি (সিইও) বললেন, “আজ কি আপনার ড্রাইভার ও গানম্যান এসেছে?” আমি বললাম, “না, শুধু ড্রাইভার এসেছে।” আমি সোজা ব্যাংকে গেলাম, দেশটা ছাড়ার জন্য টাকা উঠিয়ে নিতে। ব্যাংকে যখন ছিলাম, তখন টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছিল, “চান্দিকা বরখাস্ত, এক খেলোয়াড়কে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন।” এটা যখন সামনে এল, ব্যাংকের ম্যানেজার বললেন, “কোচ, আমি আপনার সঙ্গে আসি, রাস্তায় মানুষ আপনাকে দেখলে সেটা আপনার জন্য নিরাপদ হবে না।”’
ওই সময় থেকেই তাঁর প্রাণ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হলো। হাথুরুসিংহের ভাষ্য, ‘আমার প্যানিক করা শুরু হয়ে গেল, কারণ আমার দেশটা ছাড়তে হতো। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে মাঝরাতের এক ফ্লাইটের উদ্দেশে এক বন্ধু বিমানবন্দর পর্যন্ত দিয়ে আসে। আমি মাথায় একটা ক্যাপ আর হুডি পরে গিয়েছিলাম, কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না।’
এর আগের কয়েকদিনের ঘটনাক্রমের কথা জানিয়ে হাথুরুসিংহে বললেন, গ্রেপ্তারের আশঙ্কাও তাঁর মাথায় খেলছিল, ‘দেশ ছেড়ে পালাতে চাওয়ার অভিযোগ তুলে ওরা আমাকে গ্রেপ্তারও তো করতে পারত! এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল, যখন বিদায়ী সরকারের একজন মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালানোর সময়ে রানওয়েতে প্লেনটা থামানো হয় এবং তাঁকে নামিয়ে আনা হয়। এই সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরপর প্রবেশপথে এক্স-রে মেশিনের ওখানে বিমানবাহিনীর একজন অফিসার আমাকে বলছিলেন, “আমি ক্ষমাপ্রার্থী, কোচ। খুব খারাপ লাগছে যে আপনাকে চলে যেতে হচ্ছে!” (ধরা গলায়) আমি প্রাণ নিয়ে ভয় পাচ্ছি, আর তিনি বলছিলেন আমি তাঁর দেশের জন্য কিছু করেছি!’
তাঁর বাংলাদেশ ছাড়ার গল্পের বাইরে বাংলাদেশ দলের চাকরি হারানোর পেছনের অভিযোগ নিয়েও সবিস্তার কথা বলেছেন হাথুরুসিংহে। চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের সময়ে নাসুম আহমেদকে হাথুরু চড় মেরেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তবে হাথুরু যতটুকু মনে করতে পারেন বলে জানালেন, তা হলো, ডাগআউটে নাসুমের পেছনে বসে থাকার সময়ে মাঠে গ্লাভস পাঠাতে বলার জন্য নাসুমকে ডাকতে নাসুমের পিঠে টোকা মেরেছিলেন তিনি।
এ নিয়ে নতুন কমিটির তদন্তের সময়ে বিসিবি তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়নি বলে জানিয়েছেন হাথুরুসিংহে। নাসুমও জনসম্মুখে এ নিয়ে কখনো কথা বলেননি। তবে ওই অভিযোগের কারণে তাঁর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কোড স্পোর্টে বলেছেন হাথুরুসিংহে, ‘এটা অনেক বড় কিছু, কারণ এখানে আমার ক্যারিয়ার জড়িয়ে। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই এমন অভিযোগ এনে ওরা (বিসিবি) আমার ক্যারিয়ারটা নষ্ট করে দিয়েছে।’
তাঁর এভাবে চাকরি যাওয়ার পেছনে বিসিবির নতুন সভাপতির হাত আছে বলেই অভিযোগ করেছেন হাথুরুসিংহে, ‘আমি কখনোই কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে ঝগড়া করিনি। খেলোয়াড়দের সামনে আমি কখনোই আবেগ দেখাই না। আমি হতাশ হওয়ার মতো কিছু দেখলে হয়তো ডাস্টবিনে লাথি মারতে পারি, সেটা যে কোনো কোচই করতে পারেন। কিন্তু এটা তো যা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে পুরো উল্টো। অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কত সুযোগ যে হাতছাড়া হয়েছে, আমি গুনে বলতে পারব না। পুরো ব্যাপারটা ছিল ওদের (বিসিবি) দিক থেকে আমার চুক্তি বাতিল করার চেষ্টা। পুরো ব্যাপারটাই নতুন সভাপতির (ফারুক আহমেদ) আগে থেকে ঠিক করে রাখা সিদ্ধান্ত।’
বাংলাদেশে হাথুরুসিংহের দুই সহকারী – নিক পোথাস ও রাঙ্গানা হেরাথও অবশ্য হাথুরুসিংহে নাসুমকে চড় মারার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন। পোথাসকে উদ্ধৃত করে লেখা, ‘আমার মনে হয় যে-ই অভিযোগটা বাজারে এনে থাকুক, সে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে এটা করেছে। হয়তো সে বুঝতেও পারেনি যে এটা এত বড় ঘটনা হয়ে উঠবে। এখন যখন এত বড় ঘটনা হয়ে গেছে, আমার মনে হয় না সে (অভিযোগ ছড়িয়েছে) বুঝতেও পারছে যে সে কত বড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, এবং হাথু-র বাংলাদেশ-পরবর্তী জীবন কত কঠিন করে তুলেছে।’
নাসুমের পিঠে হাথুরু টোকা মেরেছিলেন বুঝিয়ে পোথাস বলেছেন, ‘(পিঠে টোকা মারা) সব সময়ই হয়। ভাষাগত বাধার কারণে যে কাউকে হাতের ব্যবহারে অনেক যোগাযোগ করতে হয়।’
রাঙ্গানা হেরাথ বলেছেন, ‘আমি সোজাসুজি বলতে পারি (নাসুমকে চড় মারার মতো) কিছুই ঘটেনি। বিশ্বকাপে অনেক ক্যামেরাই তো থাকে। কিছু একটা ঘটেছে বলে কেউ বলে বসতেই পারে, কিন্তু প্রমাণ তো থাকবে! আমি জোর দিয়ে বলছি কিছুই ঘটেনি, কারণ আমি ওখানে ছিলাম। চড় মারা আর টোকা মারা পুরোপুরি ভিন্ন ব্যাপার।’