ইংরেজি সালের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যতটা গভীর, বাংলা সনের সঙ্গে তেমনটা দেখা যায় না। কেন বলছি এ কথা? কারো কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, আজ বৈশাখের কত তারিখ? তখন আমরা চট করে তারিখের কথা বলতে পারি না। আমরা বৈশাখ মাসের তারিখ জানতে গুগলের আশ্রয় নিই। তাই আমরা বাংলা সনের বারোটি মাসের নাম- বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্রের কথা ভুলতে বসেছি।
ছোটবেলার কথা মনে আছে। তখন বাড়িতে ছাপা বাংলা ক্যালেন্ডার আসত। সেসব ক্যালেন্ডারে এখনকার ইংরেজী ক্যালেন্ডারের মতন একেকটা মাসের জন্য একেকটা পাতা ছিল না। বাংলা সনের বারো মাসের পাতা একসঙ্গে আঠা কিংবা পিন দিয়ে যুক্ত করা থাকত। এই ক্যালেন্ডারে বাংলা সনের তারিখের সঙ্গে ইংরেজি সালের তারিখও উল্লেখ থাকত। তবে, এখন এই ধরনের ক্যালেন্ডার চোখেই পড়ে না।
এখন চলছে এপ্রিল মাস। এপ্রিল মাস আসতে না আসতেই সারা দেশের মানুষ পয়লা বৈশাখ নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কীভাবে এই দিন পালন করবে, কী কী খাবে, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে—এসব ছাড়াও থাকে আরও নানা আয়োজন। কিন্তু শরৎ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। এমনকি সময়ের প্রবাহে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যে বাংলা মাসের রূপেরও বদলে হচ্ছে, সেটাও আমাদের চোখে পড়ে না।
আজকে এমন একজনের কথা বলবো, যিনি বনকাগজ দিয়ে বাংলা সনের বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। মজার বিষয় হলো, সেই বর্ষপঞ্জিকার পাতা মাটিতে ফেললে, সেখান থেকে উঠবে নতুন গাছ।
এই প্রকৃতিপ্রেমীর নাম সাদিকা রুমন। তিনি ছোটদের নিয়ে লিখতে ভালোবাসেন। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘হরপ্পা’ উদ্যোগের স্বত্বাধিকারী। তিনি শুরু থেকেই হরপ্পায় দেশি গয়নাসহ বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্য বিক্রি করেন। বর্তমানে পোশাক কারখানার পরিত্যক্ত কাপড় থেকে ব্যাগ তৈরি করেন। এ ব্যাগগুলো পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার উপযোগী। তবে, ‘হরপ্পা’ গত বছর থেকে বনকাগজে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে গাছ, এটি আমাদের ভাবনায় আগে কখনো এসেছে কি? কিন্তু ‘হরপ্পা’ সেটি সম্ভব করেছে। পুরোনো কাগজ রিসাইকেল করে বনকাগজ তৈরি করা হয়। এই কাগজ তৈরির সময় বিশেষ পদ্ধতিতে এর ভেতরে বীজ দেওয়া হয়। তাই বনকাগজ মাটিতে ফেললে এর ভেতর থাকা বীজ থেকে গাছ জন্মায়।
সাদিকা রুমন এই বাংলা সনের বর্ষপঞ্জি নিয়ে জানান, ‘বাংলা বর্ষপঞ্জি করার ইচ্ছেটা বহু দিনের। বনকাগজে করার প্রধান কারণ এর মাধ্যমে একটা বার্তা দেওয়া। বনকাগজ হাতে তৈরি, পুনরুৎপাদিত ও বপনযোগ্য একটি কাগজ। এই কাগজের ভেতরে বীজ দেওয়া থাকে। কিন্তু এমন নয়, এর মধ্য দিয়ে ব্যাপক সবুজায়ন ঘটে যাবে। কিন্তু যে বার্তাটি আমি দিতে চাই তা হলো, আমরা চাইলে আমাদের কিছু কিছু কাজ প্রকৃতির মঙ্গলচেষ্টায় করতে পারি। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো যথাযথভাবে মাটিতে ফেললে তা থেকে গাছ জন্মাবে, এটা একটা ম্যাজিকের মতো। আসলে প্রকৃতিই তো একটা ম্যাজিক। এই যে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে গাছ হবে, এ ঘটনাটি হয়ত আমাদেরকে একটু ভাবাবে। এই প্রেরণা থেকেই বনকাগজে বাংলা ক্যালেন্ডার করা।’
মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে নানাভাবে। অন্যদিকে প্রকৃতিকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছেন রুমন। কীভাবে প্রাণ–প্রকৃতির উপকার করা যায়, সে চিন্তায় তিনি বিভোর থাকেন। রুমনের জীবনযাপনেও এর প্রভাব দেখা যায়। পরিবেশ তাঁকে কেন বেশি ভাবায়—এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘যখন শিশুদের জন্য লিখি তখনও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকটভাবে অনুভব করি। আসলে আমাদের জীবনযাপনের ধরনটা এমন হয়ে উঠেছে যে, তা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে প্রকৃতির বিনাশকেই ডেকে আনছি। পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোটি আমাদের চিন্তা চেতনাকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। এমনকি প্রকৃতিযাপনকেও আমরা ব্যক্তিগত করে ফেলছি। প্রকৃতিও আমাদের কাছে পুঁজি। আমি এই ফাঁদটিকে অতিক্রমের চেষ্টা করি। আর কাঠামোবদ্ধ ভাবনার বাইরে নমুনা তৈরির চেষ্টা করি।’
রুমনের মতে, সফল মানুষ মানে নিখুঁত অর্থ উৎপাদন যন্ত্র। অর্থবান মানুষ নিজের জন্য প্রকৃতিও কিনে নিতে পারে। তারা হাঁসফাঁসের শহর থেকে পালাবার জন্য দূরে কোনো নদীর তীরে নিরিবিলি বাড়ি বানাতে পারেন, সবুজ কোনো রিসোর্টে গিয়ে অবকাশ যাপন করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘নির্লোভ হওয়ার শিক্ষা আমরা কোথায় পাব? সে জায়গা থেকে চেষ্টা করি প্রকৃতি নিয়ে কিছু করার।’
রুমন নিজের সচেতনতার জায়গা থেকে প্রকৃতির জন্য ভালো কিছু করতে চান। রুমন হরপ্পায় শুরুতে গয়না তৈরি করলেও এখন অব্যবহার্য কাপড় এবং পোশাক কারখানার পরিত্যক্ত কাপড় থেকে ব্যাগ তৈরি করেন। কাপড়ের ব্যাগ তৈরির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো ভাবি না, আমরা যে পোশাকটি পরছি, সেটি কতটা আবর্জনা প্রকৃতিকে উপহার দিয়ে আমাদের হাতে এসেছে কিংবা আমাদের বেসামাল ভোগ শেষ পর্যন্ত আবর্জনা হিসেবে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাচ্ছে! কেউ যখন পরিত্যক্ত কাপড় থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করবেন, তখন সেই বিষয়টি নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে ভাবিয়ে তুলবে। এই ব্যাগ পলিথিনের মতো একটি আগ্রাসী দূষণ উপকরণের বিকল্প হিসেবেও কাজ করবে। এই দুই ভাবনাকে সমন্বয় করে ব্যাগের উদ্যোগটি নেওয়া। আর বাংলা সনের ক্যালেন্ডার কিংবা কাপড়ের ব্যাগ তৈরি করা বিপুল লাভজনক বা লাভের উদ্দেশ্যে করা উদ্যোগ নয়। প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করা।’