চীনের হুমকি বাস্তব এবং এটি আসন্ন হতে পারে। আমরা এমনটা আশা করি না। তবে এটি নিশ্চিত হতেই পারে। কিন্তু আমাদের সীমানা এবং আমাদের প্রতিবেশের বাইরে, আমরা কমিউনিস্ট চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধে নিজেদেরকে নতুনভাবে সাজাচ্ছি। যারা শান্তি কামনা করে, তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এবং আমরা ঠিক এটাই করছি। চীন শেষ পর্যন্ত কী করবে, তা কেউ জানে না। কিন্তু তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এমনই এক অত্যন্ত আগ্রাসী বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে তিনি বারবার চীনকে একটি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘মার্কিন সামরিক বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না।’
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ কী বলেছেন শুনুন। তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও সাধারণ অরওয়েলীয় ফ্যাশনের (১৯৮৪ বইয়ে লেখক জর্জ অরওয়েল বর্ণিত পরিবেশ) মতো করে তিনি দাবি করেন যে, ‘শান্তির জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমার প্রথম প্লাটুনের মূলমন্ত্রই ছিল–যারা শান্তির প্রত্যাশা করে, তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এবং আমরা ঠিক এটাই করছি। আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে যুদ্ধকে প্রতিরোধ করা যায়। শক্তির মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা যায়। তাই মূলত “যুদ্ধই শান্তি”–এটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে পেন্টাগনের বার্তা।’
এই স্লোগানটি পিট হেগসেথ বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প শক্তির মাধ্যমে শান্তি চান। মার্কিন সাম্রাজ্য নিজের ডেটারেন্স বা প্রতিরোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ওই বক্তৃতায় হেগসেথ বারবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মাসে রিয়াদে নিজেই এটি বলেছেন। প্রয়োজনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমেরিকা শক্তি প্রয়োগ করতে কখনো দ্বিধা করবে না। এটাই প্রতিরোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে।
হেগসেথ বলেন, ‘ডেটারেন্স বা প্রতিরোধ ব্যর্থও হতে পারে। আর সেজন্যই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রতিরোধ ব্যর্থ হয় এবং আমার কমান্ডার-ইন-চিফ আহ্বান জানান, তাহলে প্রতিরক্ষা বিভাগ যা সবচেয়ে ভালো করে, অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধ করা এবং জয়লাভ করা–তার জন্য আমরা প্রস্তুত।’
পিট হেগসেথের এই বক্তৃতা গত ৩১ মে সাংগ্রি লা ডায়ালগে দেওয়া। প্রতি বছর সিঙ্গাপুরে এই ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়। এটি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সামরিক নেতৃবৃন্দকে একত্রিত করে।
যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা গোলার্ধে অবস্থিত। অর্থাৎ, এশিয়া থেকে অনেক দূরে এবং যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) নেতা। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবেও দাবি করে। এর মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্য প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত। তবে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশকে সামরিকীকরণ করেছে, যার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান রয়েছে। গত ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই সামরিক দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে দাবি করার এটাও একটা কারণ। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় এটি নিয়ে রসিকতাও করেছিলেন।
হেগসেথ উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার মাত্র চার মাসের মধ্যে তিনি দুবার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সফর করেছেন। যদিও তিনি একে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেন, যা মার্কিন সরকারের একটি প্রচেষ্টার অংশ। তারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, যাতে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভারতের সাথে জোট বাঁধার মার্কিন কৌশল বাস্তবায়িত হয়।
যা হোক, পিট হেগসেথ গর্ব করে বলেছেন, তিনি চীনকে হুমকি দিতে এই অঞ্চলে বারবার ফিরে আসবেন। তিনি এ কথা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিশ্বের অন্য প্রান্তে অবস্থিত হলেও এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ীভাবে থাকবে। যেমনটি বলছিলাম, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমি দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দো-প্যাসিফিকে ফিরে আসতে পেরে সত্যিই গর্বিত। আমি বারবার, বারবার ফিরে আসব। আপনারা আমার সাথে আটকে আছেন। তবে শুধু আমি নই। আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিকে ফিরে আসতে পেরে গর্বিত এবং আমরা এখানে স্থায়ীভাবে থাকব।’
এভাবেই পিট হেগসেথ তাঁর সেই আগ্রাসী বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। এর মর্মমূলে ছিল–যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং মার্কিন সাম্রাজ্য এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছে। (তিনি তাঁর বক্তব্যে এম্পায়ার বা সাম্রাজ্য শব্দটি বারবার ব্যবহার করেছেন।) যুক্তরাষ্ট্র এই পুরো অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বক্তৃতায় তিনি একাধিকবার চীনকে একটি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
চীনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনারা মার্কিন সাম্রাজ্যকে এই অঞ্চল থেকে বের করে দিতে পারবেন না। একটি হুমকি ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিকে আমরা যে হুমকির মুখোমুখি, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট সত্যের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সেই হুমকিগুলোর মোকাবিলায় অত্যন্ত বাস্তব ও জরুরি মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি এই কথা বলে শুরু করতে চাই যে, আমরা কমিউনিস্ট চীনের সাথে সংঘাত চাই না। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল থেকে আমাদের বিতাড়িত করা যাবে না।’
যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি–পিট হেগসেথের অত্যন্ত চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি চীনের দিকে আগ্রাসী বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চান। তিনি এর আগে ডানপন্থী টিভি চ্যানেল ফক্স নিউজের একজন উপস্থাপক ছিলেন। ট্রাম্প তাঁকে সবসময় টিভিতে দেখতেন এবং বলতেন, তাঁর মার্কিন সামরিক বাহিনী চালানো উচিত। হেগসেথ ২০২০ সালে একটি বই লেখেন। সেখানে তাঁর চরম মৌলবাদী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ফুটে উঠেছে। বইটির নাম ‘আমেরিকান ক্রুসেড’। এতে তিনি গর্বের সঙ্গে নিজেকে একজন ক্রুসেডার বা ধর্মযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, মার্কিন সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টান ক্রুসেডগুলো চালিয়ে যাওয়া উচিত, যা হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা একটি পবিত্র যুদ্ধ চালাচ্ছে। তিনি ‘পবিত্র যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
আর এই পবিত্র যুদ্ধের লক্ষ্য কারা? তিনি বইতে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন–সেই লক্ষ্যগুলো হলো কমিউনিস্ট চীন, আন্তর্জাতিক বামপন্থী এবং ইসলাম; অর্থাৎ, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান। এই পবিত্র যুদ্ধ যার প্রধান লক্ষ্য, তিনিই এখন পেন্টাগন অর্থাৎ মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্বে আছেন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব দাবি করেছেন, চীন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য চায়, যা একেবারেই মিথ্যা। চীন সরকার বারবার বলেছে, তারা আধিপত্য চায় না। কিন্তু মূলত পিট হেগসেথ চেষ্টা করছিলেন সাংগ্রি-লা ডায়ালগে অংশগ্রহণকারী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকে সতর্ক করতে। তিনি তাদের বলছিলেন, মার্কিন সাম্রাজ্য চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে জোট বাঁধতে চায়। তিনি দাবি করেছিলেন, চীন এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকে ধমকাচ্ছে এবং সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেননি যে, চীন ১৯৭৯ সাল থেকে কোনো যুদ্ধই করেনি। কিন্তু হেগসেথ দাবি করেছেন, চীন একটি বড় হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াকে সেই হুমকি থেকে রক্ষা করতে যাচ্ছে। আর অবশ্যই এর আসল লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখা। চীন এশিয়াতে একটি আধিপত্যবাদী শক্তি হতে চায়।
আপনি যদি চীনের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কিছু জানেন, তাহলে আপনি জানবেন যে, চীন দশকের পর দশক ধরে ক্রমাগত জোর দিয়ে আসছে যে, তারা আধিপত্য চায় না। প্রকৃতপক্ষে তারা চায় না যে, কোনো দেশ আধিপত্য বিস্তার করুক। এটি মাও সে তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের আমল থেকে শুরু করে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনেও একটি স্লোগান হিসেবে চলে আসছে। এই নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, চীন উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, চীনের ভাষায় যাকে, তারা ‘হেজেমোনিজম’ বলে। চীনা কূটনীতিকেরা এই নীতির পুনরাবৃত্তি প্রতিনিয়ত করেন। তারা চীনা শব্দ ‘বাতওয়ান’ (batwan) ব্যবহার করেন, যার অর্থ আধিপত্য এবং তারা বলেন, তারা আধিপত্য চান না।
প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭০-এর দশকে যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তখন কূটনৈতিক সংঘাতের অন্যতম কারণ ছিল এই আধিপত্য সম্পর্কিত অবস্থান। চীন দৃঢ়ভাবে চাইছিল, চীন‑যুক্তরাষ্ট্র ও চীন‑জাপান স্বাক্ষরিত যৌথ বিবৃতিতে ‘আধিপত্য-বিরোধী ধারা’ নামে কিছু একটা থাকতে হবে। জাপান অবশ্য এটি স্বাক্ষর করতে চায়নি। অবশ্যই, জাপান ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে চীনে, ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করেছিল।
জাপান চীনকে উপনিবেশে পরিণত করেছিল এবং লাখ লাখ চীনা নাগরিককে হত্যা করেছিল। সুতরাং, চীন সর্বদা আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। এটাই গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। এমনকি কিছু মূলধারার আমেরিকান পণ্ডিতও স্বীকার করেছেন, চীন আধিপত্য চাইছে না। উদাহরণস্বরূপ, ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অভিজাত এবং প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর একটি। তারা স্টিভেন ওয়াল্টের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। স্টিভেন আবার অভিজাত আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। তিনি স্বীকার করেছেন, চীন আধিপত্য চায় না। আর এই অবস্থান মূলত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যের আধিপত্য বজায় রাখার বিপরীতে চীনের একটি চেষ্টার অংশ।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র আসলে চীনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলছে, যা ওয়াশিংটন নিজেই চায়। ওয়াশিংটন এই সত্যকে ভয় পাচ্ছে যে, তার আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের বাধ্য করার চেষ্টা করছে, যাতে তারা চীনের বিরুদ্ধে নতুন স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দেয়, চীনকে দুর্বল করে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে।
প্রকৃতপক্ষে, সিঙ্গাপুরে সাংগ্রি-লা ডায়ালগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি মূলত এই অঞ্চলের দেশগুলোকে বলেছিলেন, চীনের সাথে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করা উচিত। চীনের সাথে তাদের খুব বেশি বাণিজ্য করা উচিত নয়। তিনি মূলত এই দেশগুলোকে বলছিলেন যে, তাদের হয় যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীনের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। তারা উভয় পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। কারণ, খুব শিগগিরই একটি যুদ্ধ শুরু হতে পারে। আর যদি এই দেশগুলো চীনের সাথে অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত থাকে, তাহলে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করা কঠিন হবে। যেমনটি তিনি বলেছিলেন, এটি ‘আমাদের প্রতিরক্ষা সিদ্ধান্তকে জটিল করে তুলবে’।
পিট হেগসেথের দেওয়া বক্তৃতার একটি বড় অংশ তাইওয়ানকে ওপর কেন্দ্র করে ছিল। কয়েক দশক ধরে মার্কিন সরকার তাইওয়ানের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শক্তিগুলোকে সমর্থন করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে স্বীকার করে যে, তাইওয়ান চীনের অংশ। ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র থ্রি কমিউনিকস নামে পরিচিত একগুচ্ছ কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ মেনে নেয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে যে, বিশ্বে কেবল একটিই চীন আছে এবং তাইওয়ান চীনের অংশ। এটি আন্তর্জাতিক আইনেও লিপিবদ্ধ। জাতিসংঘ তাইওয়ানকে চীনের একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি মার্কিন-প্রভাবিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো প্রতিষ্ঠানও তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছে, ‘তাইওয়ান, চীনের প্রদেশ’। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের দেওয়া বক্তৃতায়, তিনি তাইওয়ান নিয়ে ভীতি ছড়িয়েছেন। বলেছেন, কমিউনিস্ট চীন তাইওয়ান আক্রমণ করতে চায়।
হেগসেথ বলেন, ‘এটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্য একটি হুমকি। প্রতিদিন আপনারা এর মুখোমুখি হন। চীনের সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে হয়রানি করে। সকলের কাছে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, বেইজিং বিশ্বাসযোগ্যভাবে ইন্দো-প্যাসিফিকে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের জন্য সম্ভাব্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে কমিউনিস্ট চীনের তাইওয়ানকে জোর করে জয় করার যেকোনো চেষ্টা ইন্দো-প্যাসিফিক এবং বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। এটিকে মিষ্টি কথায় মোড়ানোর কোনো কারণ নেই।’
পিট হেগসেথের মধ্যে এই অদ্ভুত প্রবণতা রয়েছে যে, তিনি মার্কিন সেনাদের ক্রমাগত রণক্ষেত্রের যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেন। আপনারা জানেন, তিনি একজন কট্টর নব্য-রক্ষণশীল যুদ্ধবাজ। এই বক্তৃতা ও অন্যান্য বক্তৃতাজুড়ে তিনি ক্রমাগত গর্ব করে বলেছেন যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী কীভাবে কেবল প্রাণঘাতী ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধশক্তি, যা রণাঙ্গনের যোদ্ধায় পূর্ণ।
পিট বলেছন, ‘সুতরাং, আমরা প্রাণঘাতী ক্ষমতা, মেধার শাসন, জবাবদিহি, মানদণ্ড, প্রস্তুতি এবং যুদ্ধ-প্রযুক্তির ওপর মনোযোগ দিচ্ছি। আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করছি এবং সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও কার্যকর সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে সম্পদ পুনর্বণ্টন করছি। আমরা এটি করছি কারণ, রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের সাফল্যের জন্য এটা প্রয়োজন। আমরা ঘোষণা করেছি যে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর জাপান সদর দপ্তরের মানোন্নয়ন আমরা করছি। এটি যুদ্ধ ও প্রতিরোধের বিষয়।’ হেগসেথ গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য মার্কিন সামরিক বাজেট ১ ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারের বেশি বাড়িয়েছেন।’
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওই বক্তৃতায় বলেন, পেন্টাগন যা করার চেষ্টা করছিল, তা হলো–এশিয়ার দেশগুলোকে বলা যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী চীনের তথাকথিত আগ্রাসন প্রতিরোধে তাদের সাথে কাজ করবে। যদিও, আবারও বলছি, চীন ১৯৭৯ সাল থেকে কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর, প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে; বিশেষত এশিয়াতে। তবুও, আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, চীন একটি হুমকি!
যা হোক, পিট হেগসেথ এই দেশগুলোকে বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দিন। চীনের বিরুদ্ধে আমাদের সাথে যোগ দিন। আমরা আপনার পাশে থাকব এবং চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধে আপনার সাথে কাজ করব। চীন কিছু করতে চাইলে আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধে প্রতিদিন আমরা আরও আরও বাধার সৃষ্টি করব।’
তবে, আমাকে বলতেই হচ্ছে যে, মার্কিন এই কৌশল তেমন ভালোভাবে এগোচ্ছে না। আপনারা জানেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে হয় যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীনের মধ্যে একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশই আসলে উভয় পক্ষের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখছে।
এর একটি ভালো উদাহরণ ছিল মে মাসে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর এবং চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক। তারা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে, তারা তাদের সহযোগিতা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করবে। আর মার্চ মাসে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে আরেকটি বৈঠক হয়েছে, যেখানে তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত ও গভীর করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এমনকি তিন দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়েও কথা বলেছিল সে সময়।
এই বৈঠকে এবং আসিয়ানের সাথে বৈঠকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল ট্রাম্প সরকারের শুল্ক আরোপের হুমকি। ট্রাম্প শুধু চীনের ওপরই নয়, ভিয়েতনামসহ আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশ এবং এমনকি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্রদের ওপর উচ্চ শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছিলেন।
এই হুমকি এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করেছে। যে কারণে তারা এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ না দিয়ে, উভয় পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক রেখে একটি জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে। এ ছাড়া চীন আসিয়ান এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করবে না, যদিও ওয়াশিংটন এটাই চায়।
এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি উদাহরণ হলো ২৭ মে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহাসিক শীর্ষ সম্মেলন, যা আসিয়ানভুক্ত ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে (জিসিসি) এবং চীনকে একত্রিত করেছিল। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম আসিয়ান-জিসিসি-চীন শীর্ষ সম্মেলন। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এটি তেমন মনোযোগ পায়নি। তবে আমি মনে করি এটি ছিল ঐতিহাসিক। এটি আমরা যে ক্রমবর্ধমান বহু-মেরু বিশ্বে বাস করছি, তার একটি স্পষ্ট প্রতীক। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে তার নতুন স্নায়ুযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করার মার্কিন চেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
কিন্তু পিট হেগসেথ তাঁর বক্তৃতায় ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্ব নিয়ে গর্ব করেছিলেন। তবে, আমাকে বলতেই হবে যে, ভারতের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ততটা স্পষ্ট নয়, যতটা ট্রাম্প সরকার বিশ্বকে মনে করাতে চায়। সুতরাং, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি ভারত সরকার চীনের সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করছে।
এটা পরিষ্কার যে, চীন-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল বিষয়। কিন্তু ২০২৪ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের আগে, চীন ও ভারত তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়া পর্যন্ত এই সম্পর্ক ভালোই চলছিল। উল্লেখ্য, এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে, মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং ওয়াশিংটনের যুদ্ধবাজেরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও সংঘাতকে উৎসাহিত করছে। কারণ চীন ও পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও সংঘাত উসকে দিয়ে চীন ও ভারতের সম্পর্ক খারাপ করতে চায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়, যতটা ওয়াশিংটন বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে চায়।
ভারতেরও একটি জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক আছে। রাশিয়ার সাথেও তার খুব ভালো সম্পর্ক। চীনের সাথেও সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় পিট হেগসেথের ‘ডিবাইড অ্যান্ড রুল’ কৌশল অতিরঞ্জণ মাত্র।
তবে একটি দেশ আছে, যা মূলত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইউক্রেন হতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছে, সেটি হলো ফিলিপাইন। ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, যিনি ‘বং বং মার্কোস’ নামেও পরিচিত। তিনি ফিলিপাইনের নৃশংস সামরিক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়রের ছেলে। মার্কোস পরিবার ফিলিপাইন থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ চুরি করেছিল। তারপরও তিনি ক্ষমতার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিলেন। তার কারণ হলো প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন শাসকেরা তাঁকে প্রবলভাবে সমর্থন করেছিল।
আজ দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধে, চীনের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্র ‘বং বং মার্কোস’-কে ব্যবহার করে চীনকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে অন্তত নয়টি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করছে, যা ওয়াশিংটনের কাছে দেশটি স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের উত্তরাঞ্চলে টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে, যার পাল্লা প্রায় দু হাজার কিলোমিটার এবং এটি মূল চীনের বেশির ভাগ শহরে আঘাত হানতে পারে। এটি স্পষ্টতই চীনের জন্য একটি হুমকি।
এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সরকার সত্যি বলতে, ফিলিপাইনের নেতৃত্বের মতো এতটা বোকামি করেনি। এই সরকারগুলি বলছে, ‘না, আমরা মার্কিন-চীন যুদ্ধে জড়াতে চাই না।’ সুতরাং আবারও, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য অংশকে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথীদের একত্রিত করার জন্য ‘ভাগ কর ও শাসন কর’-এর মতো মার্কিন কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে। এই অঞ্চলের সিংহভাগ দেশ ওয়াশিংটনের নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সাথে তাল মেলাচ্ছে না। মূলত হাত মেলানোর তালিকায় আছে ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়া।
এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো নতুন ইউক্রেন হতে চায় না। সুতরাং, ঠিক যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে একটি ছায়া যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল, এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই কাজটি করাতে চায় ফিলিপাইন বা অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে।
সাংগ্রি-লা ডায়ালগে পিট হেগসেথ পানামাকেও হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা গোলার্ধে তার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এটি ঔপনিবেশিক মনরো ডকট্রিনের নামান্তর। তিনি বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্য পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেবে, যা ঔপনিবেশিকতা; স্পষ্টতই বর্তমান শতাব্দীর নব্য-ঔপনিবেশিকতা।
বাইডেনের অধীনে ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব ইলাই র্যাটনার বিষয়টি আসলে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছেন যে, দুই প্রশাসনের চিন্তায় কোনো পার্থক্য নেই। তিনি বাইডেন প্রশাসনের একজন শীর্ষ পেন্টাগন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি চীনকে যুদ্ধবাজ বলে মনে করেন। হেগসেথের চীন সম্পর্কিত কথা শুনে তিনি বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী প্রশাসনের সাথে প্রায় সম্পূর্ণ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।’ সুতরাং বাইডেন প্রশাসনের চীন নীতি এবং ট্রাম্প প্রশাসনের চীন নীতিতে সম্পূর্ণ ধারাবাহিকতা রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এটা ভালো। চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের আরও বেশি মনোযোগ প্রয়োজন।’
এটাই রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য। রিপাবলিকানদের বাগাড়ম্বর আরও স্পষ্ট এবং আগ্রাসী ও খোলাখুলি ঔপনিবেশিক। তারা বলে, চীন একটি হুমকি। যেখানে ডেমোক্র্যাটরা নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বললেও তাদের হুবহু একই নীতি রয়েছে, যা একটি সাম্রাজ্যবাদী নীতি, একটি নব্য-ঔপনিবেশিক নীতি। যা আদপে মার্কিন সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকে চূড়ায় নেওয়ার চেষ্টা করে। চীনকে হুমকি না বলে, তারা চীনকে একটি চ্যালেঞ্জ বলে। কিন্তু এটি আসলে উপরিতলের একটি কাঠামোগত পার্থক্য শুধু।
আপনারা জানেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শত শত বছর ধরে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। এটি সারা বিশ্বে ক্রমাগত যুদ্ধ চালাচ্ছে। তবুও তারা বলে–আমরা শান্তি চাই। তবে শান্তি রক্ষার জন্য আমাদের কেবল যুদ্ধ করতে হবে। এটি সেই অরওয়েলীয় ধারণা যে, ‘যুদ্ধই শান্তি’। ট্রাম্পের পেন্টাগনের বাগাড়ম্বরে এটি স্পষ্ট। পিট হেগসেথ ক্রমাগত বলে চলেছেন, তারা প্রতিরোধের মাধ্যমে শান্তি চান। তাঁর দাবি, তাঁরা চীনের সাথে যুদ্ধ চান না। তবে তাঁদের চীনের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, কথিত আছে যে, চীনই যুদ্ধ চায়। যদিও চীন ১৯৭৯ সাল থেকে কোনো যুদ্ধ করেনি।
হেগসেথ বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে যুদ্ধ চায় না। আমরা চীনকে আধিপত্য বিস্তার করতে বা গলা টিপে ধরতে, ঘিরে ফেলতে বা উসকানি দিতে চাই না।’
আমরা জানি এটি ভেক শুধু। কীভাবে জানি? কিছু বিষয় দেখলেই বোঝা যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থমন্ত্রী বিলিয়নেয়ার হেজ ফান্ড ম্যানেজার স্কট বেসেন্ট স্বীকার করেছেন, মার্কিন সরকারের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। ব্লুমবার্গ এপ্রিল মাসে এ বিষয়ে রিপোর্ট করেছে। স্কট বেসেন্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারতকে একত্রিত করে একটি দল হিসেবে চীনকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রত্যেক আগ্রাসী যুদ্ধবাজ দেশ যখন যুদ্ধ শুরু করে, তখন দাবি করে যে, তারা আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ ঠিক একই কাজ করছে। দাবি করছে, ‘আমরা চীনের সাথে যুদ্ধ চাই না। তবে আমরা শুধু চীনের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে চাইছি, যাতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বজায় থাকে।’ যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য শুধু এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নয়, সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখা। এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে দুর্বল করতে, নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ঘিরে ফেলতে এত মরিয়া।
নতুন স্নায়ুযুদ্ধের লক্ষ্য হলো চীনকে বিচ্ছিন্ন করা, দুর্বল করা এবং শেষ পর্যন্ত চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে উৎখাত করা। যাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীনের সাথে তাই করতে পারে, যা ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার, অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে করেছিল। চীনের সমস্ত সম্পদ বেসরকারীকরণ করা, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেওয়া, চীনের সমস্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে বেসরকারীকরণ করা, রাশিয়ার বরিস ইয়েলৎসিনের মতো বাধ্য পুতুলদের চীনের ক্ষমতায় বসানো, যারা যুক্তরাষ্ট্র যা চাইবে, তাই করবে। এবং চূড়ান্তভাবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে চাইবে। তাইওয়ান এবং তিব্বত ও হংকংয়ের মতো চীনের অংশগুলো বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। এটাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য। আর এই কারণেই পেন্টাগন যেমনটা স্বীকার করেছে যে, তারা চীনের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেন নর্টন: জিওপলিটিক্যাল ইকোনমি ডট কমের প্রধান সম্পাদক