বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলা সিনেমা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। নিয়মিত বিরতিতে চোখে পড়ছে এ দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্বর দাড়ি-গোঁফে ঢাকা এক ছবি। বোঝাই যায় যে, কোনো এক ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে!
সুতরাং, এমন ছবি দেখে আগ্রহ জাগাই স্বাভাবিক। তাই ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হইচই যখন ‘চালচিত্র’ নামের সিনেমাটি মুক্তির ঘোষণা দেয়, তখন আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল বেশ। সম্প্রতিই এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে। এর অনেক আগেই, অর্থাৎ গত বছরেরই শেষের দিকে সিনেমা হলেও মুক্তি পেয়েছিল এটি এবং বেশ দর্শকনন্দিতও হয়েছিল। মূলত তখন থেকেই এ দেশের অভিনেতা অপূর্বর চালচিত্র নামের সিনেমায় একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয়ের কথা শোনা যাচ্ছিল।
চালচিত্র প্রায় ১২৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি সিনেমা। ঘরানায় ক্রাইম থ্রিলার। এর গল্প সম্পর্কে হইচই লিখেছে, ‘কলকাতার অন্ধকার গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে একের পর এক নৃশংস খুন। গোয়েন্দা কণিষ্ক ও তার দলকে ডেকে পাঠানো হয় এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য। ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন ও পেশাগত দায়িত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে, সে কি এই রহস্যের জাল ছিঁড়ে খুনির বিকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারবে?’
গল্প সম্পর্কে যেমনটা বলা হয়েছে, ঠিক সেভাবে খুন দিয়েই সিনেমার শুরু হয়। গোয়েন্দা কণিষ্কসহ আরও কিছু চরিত্র পর্দায় আসে। খুনী অবশ্য আলো-আঁধারিতেই থেকে যায়। খুনের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হতে থাকে কিছু টুকরো টুকরো জীবনের গল্প। কণিষ্ক ও তার সহকর্মীরাই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। একপর্যায়ে অনেক বছর আগের এক খুনের রহস্যও আবার পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসে। সেই ঘটনায় দোষী খুনীর কাছেও যাওয়া হয়। চলতে থাকে অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে মিলিয়ে রহস্যভেদের চেষ্টা। আর বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার ক্লাইম্যাক্সের কাছাকাছি সময়ে আবির্ভূত হয় বর্তমান খুনীর চরিত্রটি। তখনই লাগে চমক!
একটি কথা বলতেই হয় যে, চালচিত্র সিনেমায় নতুন কিছু খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হয়। একটা চিরচেনা ফরমুলা মেনেই বানানো সবকিছু। এবং ওই অনুযায়ীই চলতে থাকে। নতুন কিছু বলতে আসলে অপূর্বই। এই বাংলাদেশি অভিনেতা পর্দায় আসার পর থেকেই কিছুটা অ্যাড্রেনালিন রাশ হয়, আগ্রহও তৈরি হয় কিছুটা, টুইস্ট আসে খানিকটা। তার আগ পর্যন্ত সব চলতে থাকে আসলে একেবারেই গতানুগতিক ধারায়। আবার অপূর্ব বিদায় নেওয়ার পরও ফিরে আসে একই ধারা। শেষও হয় অনেকটা অনুমিত ঢঙেই।
সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন প্রতিম ডি গুপ্ত। অভিনয়ে আরও ছিলেন টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, শান্তনু মহেশ্বরী, রাইমা সেন, ইন্দ্রজিৎ বসু, তানিকা বসু, স্বস্তিকা দত্ত, অনিন্দিতা বসু, প্রিয়া ব্যানার্জী প্রমুখ। মূলত সিনেমার প্রধান চরিত্র ছিলেন টোটা। গোয়েন্দা কণিষ্ক হিসেবে পর্দায় হাজির হয়েছিলেন তিনি। তবে টোটাকে কেন জানি বেশ নিষ্প্রভ লেগেছে পুরোটা সময়জুড়ে। একই ঢঙে অভিনয় করে গেছেন তিনি। ওঠা-নামা থাকলেও ঠিক আকর্ষণীয় বোধ হয়নি। শান্তনু মহেশ্বরী তুলনায় সপ্রতিভ ছিলেন। রাইমা সেন তেমন অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগই পাননি। তাঁর চরিত্রকে এত ছোট গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হয়েছিল যে, কিছু করারও ছিল না এই গুণী অভিনেত্রীর। অনির্বাণ নিজের কাজটুকু করেছেন যত্নের সাথে। আর ইন্দ্রজিৎ বসু তো একেবারেই নিষ্প্রাণ অভিনয় করেছেন। নিজের শরীরী উপস্থিতিকে মুখ্য করে দেখাতে গিয়ে কেন জানি আসল কাজেই পিছিয়ে গেছেন ইন্দ্রজিৎ।
তবে অপূর্ব যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন, চোখ আটকে ছিল। এ ধরনের চরিত্রে এর আগে অপূর্বকে দেখা যায়নি। কিন্তু অভিজ্ঞতার সেই অভাব একেবারেই চোখে পড়েনি। বোঝাই গেছে, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এমন চরিত্রে অভিনয় করেছেন অপূর্ব এবং সত্যি বলতে, তাঁর পারফরম্যান্স দারুণ ছিল। আশা করা যায়, এ ধরনের ভিন্নধর্মী চরিত্রে আরও বেশি করে দেখা দেবেন অপূর্ব।
কিন্তু ওইটুকু টুইস্ট বাদে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযোগী চালচিত্র আসলে তেমন চলনসই নয়। হ্যাঁ, ঝকঝকে চকচকে একটি প্রোডাকশন বটে। তবে গল্পে উপযুক্ত মোড় না থাকলে ঠিক জমে না। ছোট্ট চরিত্রে ব্রাত্য বসুকে দেখা গেলেও, কেন জানি সিনেমার ওই দৃশ্যটি দেখেই মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’–এর কথা। মাথায় এসে পড়ছিল হানিবাল লেকটাররূপী অ্যান্থনি হপকিনস। এভাবে বেশ কিছু দৃশ্য দেখে আগে দেখা অন্যান্য সিনেমার দৃশ্যসমূহ মনে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি খানিকটা অস্বস্তিরই।
সব মিলিয়ে ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে চালচিত্র গড় মানের। অপূর্বকে ভিন্ন চরিত্রে দেখা বাদে বাকিটা অনুমিত ছকেই তৈরি। যদি হাতে অকৃপণ হারে ব্যয়যোগ্য অবসর পরিমাণে ঢের থাকে, তাহলে অবশ্য দেখা যেতেই পারে!