ঘটনাস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা। এই প্রাচীন শহরকে কেন্দ্র করে পুরো পশ্চিমবঙ্গেই প্রবল প্রতাপ একটি রাজনৈতিক দলের। আর সেই রাজনৈতিক খেলাকে পোক্ত করতে ও টিকিয়ে রাখতে নিরবচ্ছিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালায় এক অপরাধী গ্যাং। এই গ্যাং’কে শায়েস্তা করতে গিয়েই লাগে গণ্ডগোল।
এমন ঘটনার প্রেক্ষিতেই শুরু হয় ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’। নীরাজ পান্ডের এই ওয়েব সিরিজটি সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে। গত মার্চের ২০ তারিখ মুক্তি পাওয়ার পর থেকে বেশ আলোচনারও জন্ম দিয়েছে নতুন খাকি। এর আগে একই সিরিজের বিহার চ্যাপ্টার মুক্তি পেয়েছিল বছরখানেক আগে। ওই প্রথম সিজনও জনপ্রিয় হয়েছিল বেশ।
কলকাতার প্রেক্ষাপটে এবারের খাকি’র অন্যতম প্রধান চরিত্র শঙ্কর বড়ুয়া। শহরের ত্রাস হিসেবে দেখানো শঙ্করকে ঠেকাতেই হাজির করা হয় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পুলিশ কর্মকর্তা সপ্তর্ষী সিনহাকে। তবে এটিও ছিল শাসক রাজনৈতিক দলের একটি চাল কেবল। রাজনৈতিক দলটির শীর্ষ নেতা বরুণ রায় চেয়েছিলেন তার প্রিয়ভাজন ও অনেক অবৈধ কাজের সহযোগী শঙ্করকে লোক দেখানো শায়েস্তা করতে। তাই শহরজুড়ে বাঘা নামে পরিচিত শঙ্কর ও তার ডান–বাম হাত সাগর তালুকদার ও রঞ্জিত ঠাকুরকে বহাল তবিয়তে রেখেই চালানো হচ্ছিল পুলিশি অভিযান। পুলিশের অভিযানের খবরও আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বিশেষ ব্যবস্থায়। কিন্তু সপ্তর্ষী যখন পুলিশ অফিসারের মতোই কাজ করা শুরু করলেন, তখনই তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবী থেকে। হ্যাঁ, কিছুটা হঠকারীভাবেই। আর তাতেই আগমন অর্জুন মৈত্র’র। এই সাহসী পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা ও সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের ত্রিমুখী লড়াই শুরু হলো। অর্জুন কি পারবে কলকাতা থেকে সন্ত্রাসরাজ দূর করতে? অর্জুনের টিমের কে আসলে হাত মিলিয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সাথে?
এমন আরও আরও প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’–এর ৭টি পর্বে। একেক নামে পরিচয় মেলে একেক পর্বের। বেশ বড় দৈর্ঘ্যের পর্ব সবগুলো। নেটফ্লিক্সে সাবটাইটেল ও অন্য ভাষার (বাংলাসহ) ডাবিং’ও আছে। ফলে ভাষার প্রতিবন্ধকতা খুব একটা নেই। তবে সিরিজটি যেহেতু মূলত হিন্দি ভাষায় নির্মিত, তাই হিন্দিতে দেখাটাই ভালো হবে। ঠোঁটের নড়াচড়া না মেলার অস্বস্তি অন্তত পেতে হবে না।
২০২২ সালের ‘খাকি: দ্য বিহার চ্যাপ্টার’ যে ফরমুলায় তৈরি হয়েছিল, বেঙ্গল চ্যাপ্টার তা থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। কপ স্টোরি যেমন হয়। তবে স্টোরিটেলিংয়ের যে ভিন্নতার কারণে বিহার চ্যাপ্টার জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেই তরিকা পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়েছে বেঙ্গল চ্যাপ্টারে। এক্ষেত্রে নতুনত্ব কম। বরং বিহার চ্যাপ্টার কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। কারণ সেটির কাহিনি নির্মাণ হয়েছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয়তা স্থান পায়নি, সুযোগও হয়নি। আর এই জায়গাতেই বেশ কিছুটা ফাঁকি দিয়েছে বাংলার খাকি।
এমনিতে প্রথম ৬টি পর্বে গল্পের গতিশীলতার অভাব ছিল না। বেশ মসৃণভাবেই এগিয়ে গেছে গল্প। দেখতে কোনো কষ্ট হয় না। উল্টো সাসপেন্স ও থ্রিলের মিশেলে এক পর্ব শেষ করেই আরেক পর্ব শুরু করার ইচ্ছা জাগে। এছাড়া সিনেম্যাটোগ্রাফি ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও ছিল দারুণ। এর সঙ্গে প্রায় খুঁতহীন অভিনয় যুক্ত হওয়ায় খাকি’র বেঙ্গল চ্যাপ্টার টানা দেখা যায়।
অভিনয় প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত বলা যাক। এই সিরিজে অভিনয়ে ছিলেন জিৎ, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চিত্রাঙ্গদা সিং, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ভৌমিক, আদিল জাফর খান, শ্রুতি দাস প্রমুখ। একেবারে তারকাদের ছড়াছড়ি যাকে বলে। খলচরিত্রে প্রসেনজিৎ দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। এমন শক্তিমান অভিনেতার উপস্থিতির কারণে এই চরিত্রটি দারুণভাবে উপভোগ্য হয়েছে। এমনিতেই বরুণ রায়ের চরিত্রটি ছিল জটিল। এটিকে সার্থকভাবেই পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন প্রসেনজিৎ। পুলিশ অফিসারের প্রধান চরিত্রে জিৎ ছিলেন পরিমিত। এমন চরিত্র তিনি বড় পর্দায় আগেও করেছেন। তবে সেগুলো ছিল কিছুটা উচ্চকিত। এবারের চরিত্রে তাই জিৎ–এর কিছুটা ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে হতো এবং সেটি তিনি ভালোভাবেই সম্পাদন করেছেন।
অন্যদিকে বাঘা চরিত্রে শাশ্বত ছিলেন একেবারে নিখুঁত। শুভাশিস, পরমব্রত, চিত্রাঙ্গদা ও শ্রুতি—সবাই যার যার চরিত্রে ছিলেন সাবলীল। তবে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন ঋত্বিক ভৌমিক ও আদিল জাফর খান। বলতেই হয় যে, এই দুই অভিনেতাকে আরও বিবিধ শেডের চরিত্রে দেখার লোভ তৈরি হয়েছে।
এবার ফাঁকির প্রসঙ্গে আসা যাক। চিত্রনাট্যের কিছু ছোট ছোট ত্রুটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উদারতা দেখানো গেলেও, সপ্তম পর্বের অতিনাটকীয়তা আহত করে বেশ। ছয়টি পর্বে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের পর শেষ পর্বের শুরুতেই দেয়া হয় দারুণ এক চমক। এতে ভর করে যখন আরও স্মরণীয় এন্ডিংয়ের জন্য চোখ আটকে থাকে স্ক্রিনে, ঠিক তখনই চলে আসে এমন কিছু দৃশ্য, যাতে কিছুটা হতাশ হয়েই পড়তে হয়। কেন জানি মনে হয় যে, নায়ক হিসেবে জিৎ’কে আরও নায়কোচিত প্রমাণ করতে গিয়েই এমন সব অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে সিরিজটির বাস্তবঘনিষ্ঠ বৈশিষ্ট্যটি মার খেয়ে গেছে।
সিরিজের গল্প যেভাবে এগিয়েছে, তাতে এতে ‘নায়ক’ নামক উপাদানটিকে জোর করে সৃষ্টি করার এবং এর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কর্মকাণ্ড প্রদর্শনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং একে সহজ ও সাবলীলভাবে এগিয়ে নিলে একটি তুলনামূলকভাবে অধিক বিশ্বাসযোগ্য পরিণতিকে পর্দায় দেখানো সম্ভব ছিল।
এটুকু ফাঁকি বাদ দিলে ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’ সত্যিই অত্যন্ত উপভোগ্য একটি সিরিজ। সবচেয়ে বড় কথা, এটি দেখে যাওয়া যায় কোনো ক্লান্তি ছাড়াই। গল্প আকর্ষণও করে বেশ। এক কথায়, অবসর সময়ে দেখার মতো দারুণ একটি সিরিজ ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’। সময় নষ্ট করার আফসোসে ভুগতে হবে না, এটি নিশ্চিত।
রেটিং: ৪.৩৫/ ৫.০০