প্রশ্নটা হলো নীতি-নৈতিকতা আর নেতৃত্বের সাথে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সম্পর্ক কী? নীতি-নৈতিকতা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এর সাথে সামাজিক আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে জড়িত? হ্যাঁ, এটার একটা যোগসূত্র আছে। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত নেতৃত্ব যে একটা দেশের কী পরিমাণ ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা অনুমান করা সহজ হবে যদি এ ব্যাপারে আমি একটা বড় উদাহরণ দিই।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দুটি দেশ ইয়েমেন ও ওমান। দেশ দুটির আয়তন প্রায় সমান, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ–প্রায় সবই এক। পাশাপাশি এই দেশ দুটির একটি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ আর অপরটি বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। সবকিছুই যেহেতু এক, তাই হয় দুটো দেশেরই হয় দরিদ্র, না হয় ধনী হওয়ার কথা। কিন্তু সবকিছু এক হলেও এক জায়গায় বিস্তর গরমিল। আর তা হলো–দেশ দুটির নেতৃত্ব।
ওমানের নেতৃত্বে ছিলেন সুলতান কাবুস বিন কাবুস। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ওমানের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন আর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধান করা। তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে তিনি ওমানি জনগণের একজন সুযোগ্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। কয়েক দশকে ওমানকে নিয়ে এসেছেন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের তালিকায়। তেল সম্পদের সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে দেশের উন্নয়নে। দেশের সম্পদকে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করে বসেননি।
এবার আসি ইয়েমেনের কথায়। পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি। ইয়েমেনের নেতৃত্বে ছিলেন আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। যদিও ইয়েমেনের এই দুর্দশার পেছনে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক চক্রের চালবাজি ছিল। দেশটাকে তারা ভাগ করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। এর মধ্যে রাশিয়া, আমেরিকা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ফলে এখানে গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব রকম অশান্তি বিরাজ করেছে। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, তা হলো নেতৃত্বের সংকট। এই আলী আব্দুল্লাহ সালেহ ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অত্যন্ত অসৎ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষজ্ঞ দল এক রিপোর্ট পেশ করে, যেখানে বলা হয়–আলি আব্দুল্লাহ সালেহ তাঁর ৩৩ বছরের ক্ষমতায় থাকার সময় অসৎ উপায়ে ৩২ থেকে ৬০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেন এবং তা বিভিন্ন দেশে পাচার করেন। তাই তেল সম্পদ থাকার পরও ইয়েমেনিরা হতদরিদ্র।
আর নেতৃত্ব যদি অসৎ হয়, তবে সেটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও কোমর বেঁধে নেমে পড়ে চুরি করতে। বিদেশি শক্তিগুলো চায় এই চোর-ডাকাতগুলো যেন ক্ষমতায় থাকে। তাতে তাদেরও লুটতরাজে সুবিধা হয়। এদের দ্বারা দেশের মধ্যে বিভেদ আর অসন্তোষ সৃষ্টি করে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ফলে তাদের অস্ত্র বিক্রি, সম্পদ লুট–এগুলো নির্বিঘ্ন হয়, আর বিপর্যস্ত হয় আপামর জনগণের জীবন‑জীবিকা। কিন্তু মূল কারণ হচ্ছে অসৎ নেতৃত্ব।
অপর দিকে ওমানের সুলতান কাবুস ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং তাঁর দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি ওমানকে একটা স্থিতিশীল ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ওমানের আইন‑শৃঙ্খলা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি দেশটাকে দেশি-বিদেশি সবার জন্য এক নিরাপদ শান্তিপূর্ণ স্থানে পরিণত করেছে। ওমানিরা জানে, সবার আগে ওরা ওমানি, এটা সবারই দেশ। এমনকি বিদেশি অভিবাসীরাও এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করে। এই সবকিছুর পেছনে আছে সুলতান কাবুসের রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় দক্ষ, সৎ আর দূরদর্শী চিন্তা।
এবারে দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ার দিকে আসি। প্রথমেই আসে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৬০-এর দশকে সিঙ্গাপুর ছিল একটা হতদরিদ্র দেশ। মাদক, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর দারিদ্র্য ছিল সিঙ্গাপুরের বৈশিষ্ট্য। একটা লম্বা ইতিহাস আছে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু সিঙ্গাপুরের এই অগ্রযাত্রার পেছনে আছে লি কুয়ানের সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব। সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট লি কুয়ানের বিরুদ্ধে স্বৈরশাসনের অভিযোগ আছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরকে এই অবস্থায় আনার জন্য সেটা একান্ত প্রয়োজন ছিল। সিঙ্গাপুর মাদক ও দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করে। আমরা কথায় কথায় যে শব্দটা ব্যবহার করি ‘জিরো টলারেন্স’–সেটারই বাস্তব প্রয়োগ ছিল সিঙ্গাপুরে। এর ফলে দুর্নীতি আর মাদক–দুটিই নির্মূল হয়ে যায় সিঙ্গাপুর থেকে। এর জন্য সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এখনো তা বলবৎ।
এসবই করা হয়েছিল সিঙ্গাপুরকে বাঁচানোর জন্য, লি কুয়ানের ব্যক্তিগত লাভের জন্য না। একবার কথা প্রসঙ্গে লি কুয়ান এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার সামনে দুইটা সিদ্ধান্ত ছিল: এক. আমি আর আমার পরিবার বড় লোক হব অথবা আমার দেশ সিঙ্গাপুর সমৃদ্ধ হবে। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছি। লি কুয়ান যদিও বহুদিন সিঙ্গাপুরের শাসনক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতিকে ক্ষমতার অংশীদার করে যাননি। তাঁদের দেশের বাইরে সম্পদ পাচার করার সুযোগ করে দেননি। সুযোগ করে দিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের মতো একটা ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। আরও আশ্চর্য ব্যাপার সিঙ্গাপুরের প্রাকৃতিক সম্পদ বলে তেমন কিছু নেই। কিছুটা একনায়কতান্ত্রিক বা পশ্চিমা সুশীলদের ভাষায় যেটাকে বলা হচ্ছে, গাইডেড ডেমোক্রেসি–সেটাই তিনি করেছিলেন দেশের জন্য; তাঁর নিজের বা পরিবারবর্গের জন্য না। আর যাই হোক তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, আর উঠবেও না।
সিঙ্গাপুরের পাশের দেশ মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের কথাও আমরা জানি। আর বেশি কিছু বলার আশা করি দরকার নেই। বিপরীত চিত্রের বহু উদাহরণও আছে। যেটা আরও অনেক বড়। আমি শুধু দুটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। এক. সিরিয়া, আর দুই. বাংলাদেশ। সিরিয়ার স্বৈরশাসক হাফিজ আল আসাদ আমৃত্যু সিরিয়া শাসন করার পর তাঁর গুণধর পুত্র বাশার আল আসাদকে সিরিয়ার মসনদে বসার ব্যবস্থা করে যান। তার পরের ইতিহাস আর বলার দরকার নেই। কারণ সবার জানা। লাখ লাখ মানুষের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল এই কুখ্যাত শাসকের শাসন। শুধু বিদেশি শক্তির খুঁটির জোরই তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে। তাঁর নিজের দেশের মানুষের হাহাকার তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি মুহূর্তের জন্যও। এমনকি এক পর্যায়ে বিষাক্ত গ্যাস পর্যন্ত ব্যবহার করার গুরুতর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এবার আসি আমাদের কথায়। আমাদের দেশে গত পনেরো বছর যে চুরিচামারি, টাকা পাচার, খুন, গুমের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটে গত বছর ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে প্রাণ নিয়ে পালাতে বাধ্য হলেও পলাতকেরা তার ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। অবুঝ শিশুরাও নিস্তার পায়নি তাদের হাত থেকে। এই উদ্ধত অহংকারীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা না গিয়ে যদি কোনো লি কুয়ান, মাহাথির বা সুলতান কাবুস বা নেলসন ম্যান্ডেলার হাতে ক্ষমতা যেত, তবে বাংলাদেশ এত দিনে হয়তো সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেত।
১৯৭০-এর দশকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া–এরা সবাই দরিদ্র দেশের তালিকায় ছিল। এমনকি চীনের অবস্থানও প্রায় ভারতের কাছাকাছি ছিল। আজ তাদের সাথে আমাদের মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, আমরা আর ওরা কোথায়।
বাংলাদেশের সব আছে, নেই শুধু সৎ আর নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব। সৎ, দক্ষ আর নিষ্ঠাবান লোকও আছে, কিন্তু আমাদের খুঁজে নিতে হবে। সামনে আমাদের নির্বাচন। বাংলাদেশের মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এই স্বপ্ন আবার দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে, যদি ঠিক মানুষকে চিনতে ভুল করি। তবে এবার আর ভুল করবে না বাংলাদেশ। বংশ পরিচয়ে আর কেউ ক্ষমতা পাবে না। সততা, দক্ষতা আর প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেবে বাংলার জনগণ; ছাড়িয়ে যাবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ব্যবসায় শিক্ষা, বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]