আজ আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি এবং ব্যবহার করি, তার বেশির ভাগই বিপজ্জনক প্লাস্টিক। পানির বোতল থেকে খাবারের থালা, শিশুদের খেলনা থেকে প্রসাধনীর মোড়ক। প্লাস্টিক মূলত কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় একে তৈরি করা হয়। ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্লাস্টিক আবিষ্কার করলেও ১৯৫৮ সালের পর থেকে এই প্লাস্টিক পৃথিবীব্যাপী ক্রেতা-ভোক্তার ক্রয়সীমানা এবং দৈনন্দিন জীবনযাপন দখল করে নিতে থাকে। পৃথিবীর জনসংখ্যার মোট ওজনের সমান প্লাস্টিক প্রতিবছর উৎপাদিত হয় (সূত্র: আর্থডে)। যদি বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক ব্যবহারের ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৫০ সালের ভেতর ১,১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হবে। দুনিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন পলিথিন সামগ্রী তৈরি হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন করে এবং প্লাস্টিক দূষণ ঘটায়। ‘প্লাস্টিকস ইউরোপের (২০২০)’ তথ্যমতে, চীন একাই ৩১ ভাগ প্লাস্টিক উৎপাদন করে। আমেরিকা, কানাডা ও মেক্সিকো উৎপাদন করে ১৯ ভাগ। ১৭ শতাংশ উৎপাদিত হয় এশিয়ায়, ইউরোপ ১৬, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা করে ৭ এবং জাপান উৎপাদন করে ৩ শতাংশ প্লাস্টিক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার শুরু হয়। ২০০২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রতিদিন একটি পরিবার গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করত। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে দৈনিক ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হতো, আর ২০০০ সালে ৯৩ লাখ। পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কঠিন বর্জ্যের দশভাগই প্লাস্টিক।
বেসরকারি পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসডোর জরিপ বলছে, দেশে বছরে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় ৮৭ হাজার টন। প্লাস্টিক পঁচে না, গলে না, প্রকৃতিতে মিশে যায় না। প্লাস্টিক ভেঙে অতিক্ষুদ্র কণা হিসেবে বাতাস, মাটি, পানি, খাদ্যচক্র এবং প্রাণীর শরীরে মিশে যায়। প্লাস্টিকের এই পচনরোধী বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং জনস্বাস্থ্যে নানামেয়াদি ও বহুমুখী দূষণ ও সংকট তৈরি করে। প্লাস্টিকর কারণে সংগঠিত এই দূষণই হলো ‘প্লাস্টিক দূষণ’। মানুষসহ পৃথিবীর সকল প্রাণপ্রজাতি, জল, স্থল, অন্তরীক্ষ এবং সমাজ-সংস্কৃতি আজ প্লাস্টিক-দূষণে আক্রান্ত এবং বিপর্যস্ত। কিন্তু এই প্লাস্টিককে কি একদিনে একভাবে ‘না’ বলে ফেলা সম্ভব? এর জন্য দরকার নানামেয়াদি পরিকল্পনা, অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়ন। সব প্লাস্টিককে প্রথমেই ‘না’ বলা সহজ না হলেও, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিককে না করবার ভেতর দিয়ে প্লাস্টিক-বিরোধী যাত্রা হয়তো আমরা শুরু করতে পারি। তাহলে কী করতে হবে? মানসিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ এবং চর্চাগতভাবে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি থেকে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্পগুলো খুঁজে এর ব্যবহারকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এভাবেই মন, শরীর, ঘর, বাজার, মুনাফা, সংস্কৃতি, উৎপাদন সকল জায়গা থেকেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিককে আমরা চাইলেই উধাও করে দিতে পারি। আর প্লাস্টিক-দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে আমাদের এই জনতৎপরতাই হতে পারে এক কার্যকর প্রাথমিক পদক্ষেপ।
প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যেতে পারে না। ১০০০ বছর ধরে ভেঙে ভেঙে এর অতিক্ষুদ্র কণা মাটিতে মিশে গিয়ে বরং পরিবেশের দূষণ ঘটায়। চাষাবাদের ফলে মাটিতে মেশা প্লাস্টিকের বিষাক্ত উপাদান উদ্ভিদে প্রবেশ করে এবং তা খাদ্যের মাধ্যমে প্রাণী ও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে (সূত্র: ইন্টারঅ্যাকটিভ এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন বুক-৮)। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে প্লাস্টিকসহ কঠিনবর্জ্য মূলত স্তূপ করে নিম্ন জলাভূমি এলাকাগুলো ভরাট করে ফেলা হয়। ঢাকার চারপাশে নিম্ন আয়ের মানুষের বসতি এলাকা ও নতুনভাবে বর্জ্য ফেলে ভরাট করা জায়গাগুলোতে প্রাকৃতিক মাটি নেই।
প্লাস্টিক দুভাবে পানি-সংকট তৈরি করে। পলিথিন-প্লাস্টিক সরাসরি খাল-নালা-নদী-জলাভূমির প্রবাহ আটকে ফেলে এবং জলাবদ্ধতা তৈরি করে। প্লাস্টিক স্তূপ জলজ জীবের খাদ্যউৎস এবং বাসস্থানকে বিনষ্ট করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পানিতে মিশে পানির গুণাগুণ এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে। নদীদূষণ ও দখলের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক-বর্জ্য। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির মতে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে মেশে। প্রতিবছর পৃথিবীতে যে ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়, যার ৮০ ভাগ গভীর সমুদ্রে ভাসমান বর্জ্যস্তূপ হিসেবে দেখা যায় কিংবা তলদেশে জমা হয় (সূত্র: আইইউসিএন, ২০২১)।
প্লাস্টিক-দূষণের কারণে কমছে পৃথিবীর প্রাণ-প্রজাতির বৈচিত্র্য। প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে প্রায় ৩৪ ভাগ সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু ঘটে (সূত্র: সেক্রেটারিয়েট, ফ্যাসিফিক রিজিওনাল এনভায়রনমেনট প্রোগ্রাম ২০০৮)। পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ অক্সিজেন উৎপাদনকারী সামুদ্রিক অণুজীব প্রোক্লোরকক্কাস প্লাষ্টিক দূষণের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন (সূত্র: ইকোলজি সেন্টার, ২০২১)। বিজ্ঞানীরা ৮৬ ভাগ সামুদ্রিক কচ্ছপ, ৪৪ ভাগ সামদ্রিক পাখি এবং ৪৩ ভাগ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক বর্জ্য এবং কণার উপস্থিতি পেয়েছেন। প্লাস্টিক-দূষণের কারণে সামুদ্রিক পাখিদের ‘প্লাস্টিকোসিস’ রোগ হয় এবং যা তাদের দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় (সূত্র: জার্নাল অব হেজারডাস মেটেরিয়ালস, ২০২৩)।
প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পরিবেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদি দূষণ ও ক্ষতি তৈরি করে (সূত্র: প্লাস্টিক পলিউশন কোয়ালিশন)। প্লাস্টিকবর্জ্য এবং দূষণ ডায়রিয়ার প্রকোপ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত তিনটি গবেষণায় মানুষের গর্ভফুল, মায়ের দুধ কিংবা রক্তেও মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা, থাইরয়েড, হৃদরোগ, প্রজনন সমস্যা, ব্যথা, বাত এবং নানাবিধ স্বাস্থ্যসংকট বাড়ছে প্লাস্টিক-দূষণের কারণে। ওষুধশিল্প এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত সামগ্রীর ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ স্বাস্থ্যসংকট তৈরি করে। কঠিন প্লাস্টিক-বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে বায়ু দূষণ বাড়ে। এমনকি প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গমন হওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এমনকি এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা।
ডাও কেমিক্যাল, লায়নডেল বেসেল, এক্সন মবিল, এসএবিআইসি, বিএএসএফ, সিবুর, স্যিন-এস্টু কেমিক্যাল, ইন্দরামা ভেনচারস, সিনোপ্যাক, ব্রাসক্যাম পৃথিবীর শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কোম্পানি। দেখা গেছে, কোকোকোলা, পেপসিকো ও নেসলের মাধ্যমে সবচে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। ২০১৪ সালে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে শীর্ষ দশ জরুরি পরিবেশগত সমস্যার ভেতর সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্যদূষণকে তালিকাভূক্ত করা হয়। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই বছরের ১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। খাবার পানি, ওষুধসহ খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বাজার থেকে প্রত্যাহার ও ধ্বংসের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন মহামান্য হাইকোর্ট ২০১৪ সালে। ২০১৯ সালে বেলাসহ ১১টি পরিবেশ সংগঠন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধে রিট করে। প্লাস্টিক টিকে থাকবার অন্যতম কারণ উৎপাদন, ভোক্তার সংস্কৃতি এবং বাজার। এখানকার পণ্য, ক্রয়বিক্রয়, বিজ্ঞাপন, ক্রেতা-ভোক্তার রুচি ও চাহিদা, সহজলভ্যতা, লাগাতার ভোগবাদী মনস্তত্ত্ব সবকিছুই মানুষকে প্লাস্টিকমুখী করে তুলে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে নিরাপদ স্বাস্থ্যকর ও দেশজ উপকরণসমূহের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিপণন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। বাঁশ-বেত, পাট, কাঠ, কাচ, কাগজ, কাপড় এবং মৃৎশিল্পনির্ভর জীবিকাকে উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে দেশজ উপাদানে তৈরি উপকরণসমূহের ব্যবহার বাড়লে দেশের পাটশিল্প, কাচশিল্প, কাঠশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, শিশু খেলনা শিল্প, হাতে তৈরি কাগজ শিল্পসহ বহু সৃজনশীল প্রাকৃতিক কুটিরশিল্প একটা নতুন চেহারা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। প্লাস্টিক দূষণ রোধ এবং বিকল্প উৎপাদনের জন্য জাতীয় বাজেটে সুস্পষ্ট বরাদ্দ রাখা দরকার। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে দেশজ প্রাকৃতিক উপাদান‑নির্ভর কুটিরশিল্পকে বিকশিত করবার ভেতর দিয়ে দেশের সবুজ অর্থনীতি বিকশিত হবে। সামগ্রিকভাবে মাতৃদুনিয়ার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে দেশের সকল নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও তৎপরতা গড়ে উঠুক প্লাস্টিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ। সুরক্ষিত হোক মানুষসহ সকল প্রাণ-প্রজাতির পরিবেশ সাম্য এবং পরিবেশ-ন্যায়বিচার।
লেখক: লেখক ও গবেষক
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]