গত ১৩ জুন বিশ্ব আবারও একতরফা সামরিক আধিপত্যের বিপজ্জনক পরিণতি দেখেছে। ইসরায়েল ইরান ও তার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গভীরভাবে উদ্বেগজনক ও বেআইনি হামলা চালিয়ে তা দেখাল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই বোমা হামলা এবং ইরানের মাটিতে বেছে বেছে হত্যার নিন্দা করেছে, যা গুরুতর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিণতিসহ একটি বিপজ্জনক উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গাজায় নৃশংস ও অসম অভিযানের মতো ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অনেক পদক্ষেপ একই ধরনের। এই অভিযানেও বেসামরিক জীবন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা দেখানো হয়েছে। এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল অস্থিতিশীলতা বাড়াবে এবং আরও সংঘাতের বীজ বপন করবে।
ইরান ও আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক প্রয়াস যখন আশার আলো দেখাচ্ছিল, ঠিক তখনই এমন একটি হামলা হওয়াটা আরও বেশি হতাশাজনক। এ বছর ইতিমধ্যেই পাঁচ দফা আলোচনা হয়েছে, যার ষষ্ঠটি জুনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সম্প্রতি গত মার্চে আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড কংগ্রেসের কাছে স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, ইরান কোনো পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালাচ্ছে না এবং ২০০৩ সালে স্থগিত হওয়ার পর থেকে এর সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি এটি পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেননি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েল
এটা মনে রাখা জরুরি যে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্বের শান্তি বিনষ্ট করা এবং উগ্রবাদকে উৎসাহিত করার একটি দীর্ঘ ও দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস রয়েছে। তার সরকারের অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, অতি-জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সাথে জোট, এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগকেই বাড়ায়নি, বরং বৃহত্তর অঞ্চলকে চিরস্থায়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিনের হত্যাকাণ্ডে মি. নেতানিয়াহু ঘৃণার আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন, যা ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক শান্তি উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটির সমাপ্তি ঘটিয়েছিল।
এই রেকর্ড বিবেচনা করে, এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে মি. নেতানিয়াহু আলোচনার পরিবর্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির পথ বেছে নেবেন। যা গভীরভাবে দুঃখজনক তা হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একসময় আমেরিকার অন্তহীন যুদ্ধ এবং সামরিক-শিল্পের প্রভাবের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন– তিনিই এখন এই ধ্বংসাত্মক পথ অনুসরণ করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। তিনি নিজেই বারবার উল্লেখ করেছেন, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা দাবি কীভাবে একটি ব্যয়বহুল যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যা ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল এবং ইরাকে অপরিমেয় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল।
ফলস্বরূপ, ১৭ জুন মি. ট্রাম্পের বিবৃতি, যেখানে তিনি তাঁর নিজের গোয়েন্দা প্রধানের মূল্যায়নকে প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেছেন যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের ‘খুব কাছাকাছি’, তা গভীরভাবে হতাশাজনক। বিশ্ব এমন নেতৃত্ব আশা করে এবং চায় যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং কূটনীতির দ্বারা চালিত হবে, বলপ্রয়োগ বা মিথ্যাচার দ্বারা নয়।
দ্বৈত নীতির কোনো স্থান নেই
ওই অঞ্চলের জটিল ইতিহাস বিবেচনা করে, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ইরান সম্পর্কে ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, দ্বৈত নীতির কোনো স্থান থাকতে পারে না। ইসরায়েল নিজেই একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তার। এর বিপরীতে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ এবং ২০১৫ সালের জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞার বিনিময়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সম্মত হয়েছিল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য, জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা সমর্থিত এই চুক্তিটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা যাচাইকৃত ছিল। ২০১৮ সালে আমেরিকা একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে আসে। সেই সিদ্ধান্ত বছরের পর বছর ধরে করা কষ্টকর কূটনীতিকে নস্যাৎ করে দেয় এবং আবারও এই অঞ্চলের ভঙ্গুর স্থিতিশীলতার ওপর একটি দীর্ঘ ছায়া ফেলে।
ভারতকেও সেই বিচ্ছেদের পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। ইরানের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর এবং চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত আছে। এই উদ্যোগগুলো মধ্য এশিয়ার সাথে গভীর সংযোগ এবং আফগানিস্তানে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছিল।
ইরান ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং সভ্যতা হিসেবে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ। জম্মু ও কাশ্মীরসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইরানের অবিচল সমর্থনের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৪ সালে, কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব আটকাতে ইরান সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী ইরান তার পূর্বসূরি, ইম্পেরিয়াল স্টেট অব ইরানের চেয়ে ভারতের সাথে অনেক বেশি সহযোগিতামূলক ছিল, যা ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে ছিল।
এদিকে গত কয়েক দশকে ভারত ও ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্কও গড়ে তুলেছে। এই অনন্য অবস্থান আমাদের দেশকে এই নৈতিক দায়িত্ব এবং কূটনৈতিক সুবিধা দেয়, যাতে আমরা উত্তেজনা কমানো ও শান্তি পক্ষের সেতু হিসেবে কাজ করতে পারি। এটি কেবল একটি বিমূর্ত নীতি নয়। পশ্চিম এশিয়াজুড়ে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক বসবাস ও কাজ করছেন, যা এই অঞ্চলের শান্তিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থের বিষয় করে তোলে।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরানবিরোধী পদক্ষেপগুলো দায়মুক্তির আবহে সংঘটিত হয়েছে, যা শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় নিঃশর্ত সমর্থনের কারণে সম্ভব হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের চালানো ভয়াবহ ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হামলার তীব্র নিন্দা করলেও, ইসরায়েলের বিপর্যয়কর এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার মুখে আমরা নীরব থাকতে পারি না। ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। পুরো পরিবার, পাড়া এবং এমনকি হাসপাতালগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গাজা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এবং এর বেসামরিক জনগণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
ভারতের উদ্বেগজনক অবস্থান
এই মানবিক বিপর্যয়ের মুখে নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের দীর্ঘদিনের এবং নীতিগতভাবে শান্তিপূর্ণ দ্বি–রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি প্রায় পুরোপুরি ত্যাগ করেছে, যা একটি সার্বভৌম, স্বাধীন ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের পাশাপাশি পারস্পরিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
গাজার ধ্বংসযজ্ঞ এবং এখন ইরানের বিরুদ্ধে বিনা প্ররোচনায় উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে নয়াদিল্লির নীরবতা আমাদের নৈতিক ও কূটনৈতিক ঐতিহ্য থেকে একটি উদ্বেগজনক বিচ্যুতিকে প্রতিফলিত করে। এটি কেবল আওয়াজ হারানো নয়, মূল্যবোধের আত্মসমর্পণও বটে।
এখনও দেরি হয়ে যায়নি। ভারতকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে, দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে এবং পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমিত করতে ও সংলাপে ফিরে আসার জন্য উপলব্ধ প্রতিটি কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করতে হবে।
সোনিয়া গান্ধী: কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপারসন
(সোনিয়া গান্ধীর এই লেখাটি চেন্নাই-কেন্দ্রিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনায় ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।)