‘রানির বাড়ি’ তথা রানি ভবানীর দুর্গ নিয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় নানা গল্প প্রচলিত। উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের দরদরিয়া গ্রামে রানির বাড়ি রয়েছে– একথা লোকমুখে শোনা যেত। মধ্যযুগের কাহিনির সেই বাড়ির অস্তিত্ব এবার সত্যিই মিলেছে। মাত্র ২২ দিনের চেষ্টায় একদল প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ‘রানির বাড়ি’তথা রানি ভবানীর দুর্গ খুঁজে বের করেছেন।
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ গত ২৬ ডিসেম্বর দরদরিয়া দুর্গ বা রানির বাড়ি প্রত্নস্থানটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কাজ শুরু করেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মধ্যযুগের ইট নির্মিত দুর্গ এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। স্থানীয়দের মুখে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস হাতে ধরা দেয়।
খনন শুরুর পর থেকে বের হয়ে আসছে, প্রাচীন স্থাপত্যের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে, প্রাচীনকালে নিরাপত্তা কৌশল ও স্থাপত্য শৈলীর বিচক্ষণতার চিহ্ন।
প্রাচীন ইতিহাস হাতে ধরা দেওয়ার এ বিষয়টি সবাইকে জানানোর জন্য শুক্রবার বিকেলে দরদরিয়া দুর্গে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি।
এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কাপাসিয়ার রানির বাড়ি বা দরদরিয়া দুর্গে খনন কাজ গত ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়। প্রাথমিক জরিপে দুর্গের আকার আকৃতি পরিমাপ করা হয়েছে। পূর্বদিকে অর্ধচন্দ্রের পরিধিব্যাপী পরিখা এবং পশ্চিমের দিকে রয়েছে বানার নদ। দুর্গটি প্রকৃতি এবং মানব সৃষ্ট এক দারুণ কৌশলগত প্রতিরক্ষার কথা চিন্তা করে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি সমতল ভূমি থেকে মাটির নিচে ২ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত দেয়ালের প্রশস্ত ৬৫ সেন্টিমিটার। প্রাচীরের উপরের অংশগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত রয়েছে। এটি মূলত একটি প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।’
এই প্রত্নতাত্ত্বিক বলেন, ‘সামরিক দিক বিবেচনায় বুরুজটি খুবই কৌশলগত স্থাপনা। এর অংশ থেকে সহজে সোজা ডানে এবং বায়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ ওই স্থান থেকে গোলা বারুদ বা তীর নিক্ষেপ করা যেত। দুর্গের বাইরে যে পার্কটি রয়েছে, তা প্রায় দুই কিলোমিটার বিস্তৃত- যা গিয়ে নদীর সঙ্গে মিশেছে। দুর্গটি সরলরেখায় কোথাও ১৪০০ মিটার প্রশস্ত, কোথাও ৪০ মিটার আর উচ্চতা পাঁচ মিটার। এই দুর্গটির চারপাশে বর্তমানে কৃষি জমি, চালা জমি রয়েছে। রয়েছে গজারি বন-জঙ্গল যা প্রায় ১৫ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত। এটি ছিল তিন স্তর বিশিষ্ট দুর্গ, যা প্রাচীনকালে খুবই শক্তিশালী দুর্গ।’
‘দ্বিস্তর বিশিষ্ট দুর্গ ভারতবর্ষে হাতে-গোনা কয়েকটি। সেই হিসেবে দ্বিস্তর বা তিনস্তর বিশিষ্ট দরদরিয়া দুর্গ একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।’ যোগ করেন অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বৈজ্ঞানিক ও ভূতত্ত্ব গবেষক জেমস টেলর তাঁর ঢাকার টপোগ্রাফি এবং পরিসংখ্যানের একটি স্কেচ (১৮৪০) বইয়ে তোগমা বা টোক শহর ব্রহ্মপুরে তীরে অবস্থিত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, তোগমা বা টোক শহর রাজা শিপালের সময়ে বন্দর ছিল।
বইটিতে টেলর আরও উল্লেখ করেন, কাপাসিয়ার দরদরিয়ায় বানার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। বলা হয়, দুর্গটি বানিয়া রাজা কর্তৃক নির্মিত। দুর্গটির বাইরের প্রাচীর মাটি দিয়ে নির্মিত। প্রাচীরের উচ্চতা ১২-১৪ ফুট। প্রাচীরের পরিধি প্রায় ২ মাইল এবং এর প্রস্থ প্রায় ৩০ ফুট। দুর্গের ৫টি প্রবেশদ্বার ছিল, তবে ইট বা পাথর নির্মিত প্রবেশদ্বার বা তোরণের কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রাচীরটি অর্ধচন্দ্রাকার করে নির্মিত। এই প্রাচীরের কিছুটা দূরে আরেকটি প্রতিরক্ষা প্রাচীরের চিহ্ন রয়েছে। এটি ইট দিয়ে নির্মিত। অনুমান করা হয় যে, এই প্রাচীরে তিনটি প্রবেশদ্বার ছিল। দুর্গটি ‘রানির বাড়ি’ নামে পরিচিত। বলা হয়, বানিয়া রাজাদের শেষ বংশধর রানি ভবানী ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম অভিযানের সময় এই দুর্গে বসবাস করেছিলেন।
জেমস টেলরের মতে, এটিই ঐতিহাসিক একডালা দুর্গ। বাংলার দ্বিতীয় স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের আক্রমণের শিকার হলে একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। দিল্লীর সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলক এজন্য ২২ দিন অপেক্ষা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জন ইতিহাস ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. নূহ-উল আলম লেনিন।