গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা হলো। পর্যটকসহ ৩৬ জনের প্রাণ গেল। এর পর থেকেই ওই হামলার জন্য পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলছে ভারত। পাকিস্তান অবশ্য ধারাবাহিকভাবেই সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে নানা ধরনের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপও নিয়েছে এ দুই দেশ, হম্বিতম্বিও করেছে। এবার পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সামরিক অভিযানই চালিয়ে ফেলল ভারত। পাকিস্তান আবার হুঙ্কার দিয়েছে, পাল্টা জবাব তারাও দেবে। তবে কি ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ বেঁধেই গেল? নাকি যুদ্ধের নামে অন্য কিছু চলছে?
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানোর যে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল, তা বাচনিক রূপেই ছিল। ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে একেবারে অকাট্য কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করেনি। করার প্রয়োজনও কি খুব একটা আছে? কারণ বিষয়টা যখন যুদ্ধ‑যুদ্ধ খেলা সম্পর্কিত, তখন এসবের তোয়াক্কা কোনো পক্ষই করে না। ইরাকে কি আমেরিকা করেছিল? কিংবা যুক্তরাজ্য? নাহ্, করেনি। গাজা নিয়ে ইসরায়েল বা হামাসও করে না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে একই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানও করত না। কারণ এ ধরনের ‘খেলা’য় সব পক্ষেরই অজুহাত প্রয়োজন হয়।
ভারত যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নেবে, সেটি এক অর্থে অনুমিতই ছিল। অন্তত ভারত ও পাকিস্তানের গত ১০ বছরের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে যারা একটু-আধটু খোঁজখবর রাখেন, তারা এই অনুমান করতেই পারবেন। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা করে, তাতে রসদ জোগায় এ ধরনের সামরিক পদক্ষেপ। আবার দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতায় থেকে বিজেপি যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি দিয়ে সাধারণ মানুষকে খেপানোর ও ভোলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে এমন পদক্ষেপ ছাড়া জনক্ষোভ প্রশমিত করারও সহজ কোনো রাস্তা আদতে নেই। ফলে ভারতে মোদি সরকারকে এমন পদক্ষেপ নিতেই হতো এবং তারা তা সানন্দেই নিয়েছে বলতে গেলে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকার কাঠামোর জন্যও ভারতকে ‘চিরশত্রু’ বানিয়ে রাখা খুবই প্রয়োজন। ওটি হলো পাকিস্তানের রাজনীতির সহজ ‘কার্ড’। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরেই নাজুক অবস্থায় আছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও নানা সংকটে আছেন। এর আগে ইমরান খানের সময় রাজনৈতিকভাবে অন্তত কিছুটা হলেও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি পুণরুদ্ধারের পথে ছিল পাকিস্তান। একটু হলেও ‘গ্ল্যামার’ ফিরে আসছিল। এবং বলতে দ্বিধা নেই, ২০১৯ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এবারের মতোই যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে ভালোই ব্যাট চালিয়েছিলেন অলরাউন্ডার ইমরান। ভারতীয় পাইলটকে আটক করা এবং পরবর্তীতে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক জয় পাকিস্তানেরই হয়েছিল।
তবে পাকিস্তান এখন আর সেই অবস্থায় নেই। দেশটির শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর বারংবার নাক গলানোর অভিযোগ এখনও আছে বহাল তবিয়তে। আবার বেলুচিস্তানসংক্রান্ত গৃহবিবাদ ও বিদ্রোহ নিয়ে বেশ সংকটে আছে দেশটি। আবার পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির একটি অংশ চায়ই না যে, কখনও দেশের বেসামরিক রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী হোক। আর কে না জানে, যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে ফপর দালালি বা নাক গলানো সবচেয়ে সহজে করা যায়। সুতরাং, পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে যুদ্ধাবস্থা তৈরি থাকলে পাকিস্তানেরই লাভ। দেশটির ডিপ স্টেটের এতেই সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা।
যুদ্ধ বাধলে বা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি হলে অস্ত্রের ব্যবসাও ভালো হয়। এই প্রক্রিয়ায় আবার সংঘাতে জড়ানো দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পক্ষ যেমন লাভের গুড় খায়, তেমনি আন্তর্জাতিক নানা পরাশক্তিরও বগল বাজানোর উপলক্ষ তৈরি হয়। ভারত ও পাকিস্তানে দুর্নীতির অস্তিত্ব নেই, তা নিশ্চয়ই বলা যাবে না। এ দিয়েই দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পক্ষের হাসিমুখের কারণ বোঝা যায়। আর আন্তর্জাতিক পরাশক্তির বগল বাজানো? চলুন, কিছু হিসাব জানা যাক।
২০১৯ সালে কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক কনভয়ে হামলার জবাবে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। ওই যুদ্ধাবস্থার পর থেকে দুই দেশই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনযোগ দেয়। ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারত কেনে রাফাল যুদ্ধবিমান। বেশ ভালো সংখ্যাই কেনে। কারণ রুশ যুদ্ধবিমানের বহরকে হালনাগাদ করার চাপ ছিল ভারতের ওপর। এর জবাবে পাকিস্তান যায় চীনের কাছে, কেনে জে-১০ যুদ্ধবিমান। একে রাফালের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে চীন। রাফালে চলে মেটেওর এয়ার টু এয়ার মিসাইল, জে-১০ চালায় পিএল-১৫ মিসাইল। রাশিয়ার কাছ থেকে এই সময়কালের মধ্যেই অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম এস-৪০০ কিনেছে ভারত। এর পাল্টা জবাব হিসেবে পাকিস্তান আবার চীন থেকে কিনে ফেলেছে এইচকিউ-৯।
যুদ্ধবিমান, মিসাইল এসব তো আছেই। এর পাশাপাশি যুদ্ধে এখন ড্রোনের ব্যবহারও বেশ আকর্ষণীয়। এক্ষেত্রে ভারত মুখাপেক্ষী হয়েছে ইসরায়েলের, কিনেছে হেরন মার্ক ২। আমেরিকার কাছ থেকেও ড্রোন কেনার অর্ডার দিয়ে রেখেছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তান গেছে তুরস্কের কাছে, সংগ্রহ করেছে তুর্কি ড্রোন, যেগুলো ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সফলও হয়েছে। ওদিকে আমেরিকার কাছ থেকে এফ-১৬ কেনা নিয়েও ভারত আলোচনা চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই।
এখন, এই সমস্ত অস্ত্রবাণিজ্য কিন্তু হয়েছে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবের মধ্যেই বা এক ধরনের শত্রুতাপূর্ণ আবহের মধ্যেই। তাহলে যুদ্ধ বেঁধে গেলে কী হবে? ভেবে দেখুন একবার। তাতে কার কেমন লাভ হবে, সেটিও অনুমান করা যায়। যুদ্ধ চললে বরং সমস্যা বেশি, ক্ষতিও। কারণ যুদ্ধ চালানোরও তো দৈনিক ভিত্তিতে আকাশচুম্বী খরচ আছে। আছে অর্থনৈতিক নানা ক্ষয়ক্ষতিও। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চললে, ওই অভিঘাত এড়ানো যায়। তখন লাভের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যায় স্বাভাবিকভাবেই!
যুদ্ধ চালানোর খরচের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন অর্থনীতির খোঁজও একটু নেওয়া যাক। এবারের যুদ্ধাবস্থার প্রাক্কালে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ শক্তিশালী। পূর্বাভাস দেওয়া বিভিন্ন সংস্থার হিসাব দেখলেও এটি বোঝা যাবে। এতদঅঞ্চলে ভারতের অর্থনীতি বেশ দ্রুত হারে এগোচ্ছে, হয়তো অন্যদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধিও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধে জড়ালে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে বেশ কম। কারণ দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা পাকিস্তানের তুলনায় ঢের ঢের বেশি। তবে হ্যাঁ, যে কোনো যুদ্ধেই দিনপ্রতি খরচ ব্যাপক হয়। এটি আরও বেশি হয়, যখন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাভূত করতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে ভারতকে এবং সেটি দীর্ঘ সময় ধরেই চালাতে হবে। পাকিস্তানের অবস্থা এমন নয় যে, ভারত ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ হিসাবে বিজয়ীর বেশ ধরতে পারবে। আর এই দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চালাতে গেলেই ভারতের অর্থনীতিও সংকটের মুখোমুখি হবেই। কারণ বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও যে ফুরায়!
যদিও পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই নানামাত্রিক সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ তো পরের বিষয়, যদি সীমান্তে সংঘাতময় পরিস্থিতিও দীর্ঘ সময় ধরে চলেই, তাহলেই আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে পাকিস্তানকে। দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকদিন ধরেই নাজুক। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফের ৭ বিলিয়ন ডলারের বেইলআউট প্রোগ্রামের ফাঁদে বেশ ভালোভাবেই আটকে আছে পাকিস্তান। আবার চীনও বজ্র আঁটুনি নিয়ে উপস্থিত। সদ্য জিডিপি বৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করেছে পাকিস্তান, মূল্যস্ফীতি সবে কমতে শুরু করেছে। এই সময়ে যে কোনো যুদ্ধ পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আবারও বিপর্যস্ত করে তুলবে সঙ্গতভাবেই। রেটিং এজেন্সি মুডি’স বলছে, এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে জড়ালে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। ফলে অন্য দেশের ও সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে করে ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেশটির অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে এটুকু বলাই যায় যে, পরমাণু যুদ্ধ তো অনেক পরের ব্যাপার, পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধে জড়ানোর চেয়েই ভারত ও পাকিস্তান–দুই দেশের জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ ‘নাটক’ করাই বেশি লাভজনক। এতে দুই দেশের জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় প্রায় উন্মাদের পর্যায়ে চলে যাওয়া অতি উৎসাহী জনতার অংশকেও জনতুষ্টিবাদী হুঙ্কার শুনিয়ে সন্তুষ্ট রাখা যাবে সহজে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে ফুটেজও খাওয়া যাবে। আবার অস্ত্রবাণিজ্যও চাঙা হবে। তো, এসব হিসাব-নিকাশ যদি এই লেখকের মতো অভাজন করতে পারে, তবে কি আর যুদ্ধ বাঁধানোর চাবি হাতে নিয়ে বসে থাকা নেতারা করছেন না? কী মনে হয়? লাভক্ষতির হিসাব করা তো মানবসভ্যতার একটি চিরন্তন অভ্যাস, তাই নয় কি!
দিনশেষে কথা আসলে একটাই। সেটি হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব সময়ই বিবদমান দুই বা ততোধিক দেশের সাধারণ মানুষগুলোই আদতে ক্ষতির সম্মুখীন হবে কেবল। ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত স্বামীর পাশে শূন্যদৃষ্টিতে বসে রইবে কোনো নববধূ। পাকিস্তানের কোটলি বা মুজাফফরবাদে হয়তো ঘুমের মধ্যে উড়ে আসা মিসাইলের আঘাতে বাবা-মা’কে হারিয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেবে কোনো হাত-পা হারানো বালক। তাদের চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যাবে। একসময় আর হয়তো কান্নার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।
ঠিক তখনি, এসব দেখেশুনে, দুই দেশের গণতান্ত্রিক মুখোশ পরা একালের রাজা-অমাত্যরা সহাস্যে বলে উঠবেন, ‘তাতে কী আর এসে গেল!’
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]