পরিবেশ রক্ষা এখন নিছক একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি নয়–এটি এক বৈপ্লবিক ন্যায্যতা, টিকে থাকা ও মানবাধিকারের আন্দোলন। পরিবেশকে শুধু প্রকৃতি, গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়–এটি মানুষের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’ (Ending Plastic Pollution) আমাদের সামনে এই বাস্তবতাকে আরও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করে।
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক দূষণ এখন এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। এই সংকটের অন্যতম ভুক্তভোগী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার সিংহভাগই সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার বা নিষ্পত্তি করা হয় না। ফলস্বরূপ এই বর্জ্য নদী, খাল ও সমুদ্রপথে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে তোলে। এগুলো মাটি ও পানিকে বিষাক্ত করে এবং খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন উৎপন্ন প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয় বলে ওয়েস্ট কনসার্ন‑এর ২০২০ সালের গবেষণায় জানা যায়। বাকি অংশ জমা হয় ল্যান্ডফিলে, নদী-নালায় ফেলা হয়, কিংবা এলোমেলোভাবে পড়ে থেকে নগর পরিবেশ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও কৃষিজমির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তবে প্লাস্টিক দূষণই একমাত্র হুমকি নয়। বাংলাদেশের পরিবেশ বর্তমানে বহুমাত্রিক সংকটের সম্মুখীন–বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী দখল ও কৃষিজমি হ্রাস–সব মিলিয়ে একটি বিপর্যয়কর চিত্র তৈরি করছে।
বন ও পাহাড় ধ্বংস: এক উদ্বেগজনক ধারা
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ২ দশমিক ৬২ লাখ হেক্টর বনভূমি হারিয়ে গেছে, যা দেশের মোট বনভূমির ১৩ শতাংশ হ্রাসের সমান। বন নিধনের পাশাপাশি পাহাড় কাটা একটি গুরুতর ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহর ও পার্বত্য এলাকায় ইতোমধ্যে ১২০টিরও বেশি পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এই পাহাড় কাটা শুধু বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করেনি, বরং ভূমিধস, জলাবদ্ধতা ও জীববৈচিত্র্য বিনাশের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন মানুষের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
নদী দখল ও দূষণ: অস্তিত্বের সংকট
বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো প্রতিদিন শিল্পবর্জ্য ও অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৫০০টির বেশি নদী দখল, দূষণ ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে। একসময়ের প্রমত্তা নদীগুলো আজ খাল বা নালায় পরিণত হয়েছে। রাজশাহী, নওগাঁ, বরিশাল, রংপুর এবং উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর অস্তিত্ব হারানো এবং পানির সংকট কৃষি ও মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
কৃষিজমির সংকোচন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ একর কৃষিজমি হারিয়ে গেছে। ভূমি দখল, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই হার আরও বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যার বড় অংশ উপকূলীয় কৃষিজমি। এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক কৃষক, ভূমিহীন জনগোষ্ঠী, নারী ও শিশুদের খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থান ও জীবিকা চরমভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
পরিবেশ রক্ষায় যুবদের শক্তিশালী ভূমিকা
এই সংকট মোকাবিলায় যুবসমাজের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। তারা শুধু পরিবেশ আন্দোলনের অংশ নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার অন্যতম চালিকাশক্তি। শহর ও গ্রামে তরুণরা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সচেতনতা বৃদ্ধি, বৃক্ষরোপণ, জলাধার রক্ষা এবং স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যচিত্র ও গবেষণা উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে পারে। পরিবেশ‑সংক্রান্ত শিক্ষা ও ক্যাম্পেইনে যুবদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে তা সামাজিক পরিবর্তনের গতিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। ইতোমধ্যেই অনেক তরুণ পরিবেশ কর্মী নদী ও পাহাড় রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।
ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণমূলক নীতি ছাড়া পরিবেশ রক্ষা অসম্ভব
এই বাস্তবতা আমাদের স্পষ্ট করে বলে দেয়, পরিবেশ রক্ষা কোনো একক ইস্যু নয়–এটি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ, পরিবেশ ধ্বংসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর। তাই পরিবেশ রক্ষায় প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন জনগণের অংশগ্রহণ–বিশেষ করে নারী, কৃষক, জেলে, আদিবাসী ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে স্বীকৃতি দেওয়া।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত ন্যায়ের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা না গেলে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’ হোক আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস ও আন্দোলনের মূলমন্ত্র।
প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানেই মানুষকে রক্ষা করা। পরিবেশ বাঁচান, মানুষ বাঁচান। প্রাণ ও প্রকৃতি একসাথে টিকলেই টিকবে সভ্যতা।
লেখক: মানবাধিকার ও পরিবেশ অধিকার কর্মী
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]