১৯৪০ সালের ১৪ নভেম্বর লুফৎওয়াফে (জার্মান বিমান বাহিনী) কভেন্ট্রিতে চালানো বোমা হামলাকে একটি অসাধারণ প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে দেখেছিল। জার্মান প্রচার মাধ্যম এই হামলাকে ‘যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করে। নাৎসিদের প্রধান প্রচারক জোসেফ গোয়েবলস এই হামলায় এতটাই আনন্দিত হন যে, এর সম্মানে তিনি একটি নতুন শব্দ তৈরি করে ফেলেন: ‘কোভেন্ট্রেট’ (Coventrate)। তবে, এই ‘পূর্ণ বিজয়’-এর আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন দ্রুত বিকল্প কারখানায় স্থানান্তর করা হয়। ফলে উৎপাদনের ক্ষমতা কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ধ্বংস হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যেই কারখানাগুলো পূর্ণ উৎপাদনে ফিরে এসেছিল।
আমরা এখন জানি যে, বিধ্বস্ত কভেন্ট্রি ক্যাথেড্রালের ছবি আমেরিকায় (যারা তখনো যুদ্ধে যোগ দেয়নি) কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে জার্মানরা চিন্তিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, জার্মানরা ব্রিটিশদের পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি ভুলভাবে মূল্যায়ন করেছিল। ব্রিটিশরা এর প্রতিক্রিয়ায় এমনভাবে আঘাত হানার সংকল্প করেছিল, যা আগে কখনো হয়নি। এর কিছুক্ষণ পরই রয়্যাল এয়ার ফোর্স জার্মানির ওপর ব্যাপক বোমা হামলা শুরু করে।
ইসরায়েলের কৌশলগত পরাজয়
ইরানের ওপর তাদের আকস্মিক হামলার প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের হাই কমান্ড যে ‘পূর্ণ বিজয়’ দাবি করেছিল, তা একটি কৌশলগত পরাজয়ের মতো দেখতে ১২ দিন লেগেছে। আর তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি মানতে ব্যাপক অনীহা দেখা গেছে।
এই যুদ্ধে ইসরায়েলের তিনটি লক্ষ্যের কোনোটিই পূরণ হয়নি। ট্রাম্প যেমন দাবি করেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ‘সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়েছে–তেমন কোনো প্রমাণ এখনো নেই।
ইরান তার কিছু সেন্ট্রিফিউজ ক্ষতির হাত থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় পেয়েছিল এবং ৪৫০ কিলোগ্রামের বেশি উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত কোথায় রাখা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। এদিকে হামলার প্রথম কয়েক ঘণ্টায় নিহত কয়েক ডজন জেনারেল ও বিজ্ঞানীর স্থলে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখা ও ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির একটি মূল্যায়নে দেখা গেছে যে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন সামরিক হামলা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উপাদানগুলো ধ্বংস করতে পারেনি। কেবল কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দিতে পেরেছে। সিএনএন মঙ্গলবার এমন তিনজনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, যারা এই মূল্যায়ন দেখেছেন।
ঝড় মোকাবিলা
যদি কভেন্ট্রির ঘটনা থেকে কিছু শেখার থাকে, তাহলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক উৎপাদন কয়েক মাসের মধ্যেই আবার চালু হবে, যেমনটা আমেরিকানরা দাবি করছে। প্রযুক্তি, জ্ঞান ও সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের জন্য ইরানি জাতির সংকল্প–সবকিছুই এই ঝড় মোকাবিলা করেছে।
স্পষ্টতই, ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যে ক্ষতি করেছে, তাতে ইসরায়েলের দ্বিতীয় যুদ্ধের লক্ষ্য অবশ্যই ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহর। ইসরায়েলের জন্য এটি একটি স্পষ্ট ও চলমান হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে।
যুদ্ধের ১২ দিনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে ইসরায়েল যত ক্ষতির শিকার হয়েছে, তার চেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে হামাসের তৈরি রকেট বা হিজবুল্লাহর সাথে মাসের পর মাস যুদ্ধ করে। ১২ দিনে ইসরায়েলি সেনাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে এমন ক্ষতি হয়েছে, যা আগে কেবল ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজা ও লেবাননে ঘটেছে। এটিও একরকম ধাক্কা ছিল। একটি তেল শোধনাগার এবং একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে ইরান। তারা ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলোতেও হামলার খবর দিয়েছে, যদিও ইসরায়েলের কঠোর সেন্সরশিপের কারণে এসব দাবি যাচাই করা কঠিন।
আর অবশেষে, ইরানি শাসন এখনো টিকে আছে। বরং ইসরায়েলের বিনা প্ররোচনায় হামলার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ক্রোধের কারণে এই শাসন দেশকে বিভক্ত না করে একত্রিত করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আরেকটি বড় ‘অর্জন’–আমেরিককে এই যুদ্ধে টেনে আনা। এখন তো তা একটি বিষাক্ত পানীয়ের মতো দেখাচ্ছে। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর যুদ্ধযন্ত্রের ওপর একটি কঠিন ও অকাল ব্রেক কষার পর তেল আবিবের একটি কেন্দ্রীয় সড়কে ‘ধন্যবাদ, মি. প্রেসিডেন্ট’ ব্যানারটি আর কতদিন থাকবে?
১২ দিন আগে, ট্রাম্প ইসরায়েলের ওপর ইরানের আকস্মিক হামলায় আমেরিকার জড়িত থাকার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যখন তিনি দেখলেন এটি সফল হচ্ছে, তখন ট্রাম্প এই প্রকল্পে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে বলেছিলেন যে, এটি কেবল মার্কিন প্রযুক্তির সাহায্যেই সম্ভব হয়েছিল।
আক্রমণ চলতে থাকলে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেও ইরানের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের বিরোধী নন। কিন্তু শেষ ২৪ ঘণ্টায়, ট্রাম্প ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দাবি থেকে সরে এসে কাতারের আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে হামলার উদ্দেশ্যের জন্য আমেরিকাকে সতর্ক করায় ইরানকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এবং ‘আমাদের সময়ে শান্তি’ ঘোষণা করেছিলেন।
পরিস্থিতি পরিবর্তন
নেতানিয়াহুর ইরানকে গাজার মতো ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও শক্তিশালী করার পরিবর্তে, ট্রাম্প এমন একটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন, যা সবে শুরু হয়েছিল। এবং গাজার বিপরীতে, নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো অবস্থানে নেই। ট্রাম্পের নিজেরও একটি এমন উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা ছিল। কারণ এর বিরুদ্ধে ছিলেন তাঁর দলের অর্ধেক সদস্য।
নেতানিয়াহুর জন্য, এই বিগত ১২ দিন ছিল এক কঠিন শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। যদিও প্রথম দিন প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যেমন সাফল্য অর্জন করেছিল, তেমনি ইরানের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কমান্ডের প্রথম স্তরকে নির্মূল করে একই সাফল্য অর্জন করতে পারে। একইভাবে ইসরায়েল সরাসরি মার্কিন সহায়তা ছাড়াই এই সবকিছু একা করতে পারে। অথচ ১০ দিনের মধ্যে এটি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে, আমেরিকা যোগ না দিলে ইসরায়েল এই যুদ্ধে তার কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।
কিন্তু ওয়াশিংটনকে শুধু ইসরায়েলের একটি প্রকল্পে যুক্ত করার জন্য নেতানিয়াহু ইসরায়েলে যত প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, সেই প্রশংসার কালি শুকানোর আগেই ট্রাম্প তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র থেকে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি এক কোপে কাজ শেষ বা ওয়ান-হিট ওয়ান্ডার বলেই প্রমাণিত হয়েছেন। ফোর্দোতে মাটির গভীরে প্রোথিত পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাটি সত্যিই অকার্যকর করা হয়েছে কিনা, তা মূল্যায়ন করার জন্য সময় না নিয়েই ট্রাম্প ‘মিশন সম্পন্ন’ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ট্রাম্প সন্দেহজনক গতিতে এটি করেছিলেন। কারণ, ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কোনো মার্কিন সেনাকে হত্যা না করার জন্য ইরানকে অভিনন্দন জানানোর একটা তাড়াহুড়ো ছিল। ঠিক যেভাবে তিনি রিয়াদে গিয়ে অর্থ আদায় করার আগে ইয়েমেনে হুতিদের সাথে চুক্তি করেছিলেন, ঠিক তেমনই।
অন্যদিকে, এই সংঘাত থেকে ইরান কৌশলগত লাভ নিয়ে বেরিয়ে আসছে। যদিও এটি তাৎক্ষণিক যে আঘাত সহ্য করেছে এবং শত শত হতাহতের শিকার হয়েছে, তা উপেক্ষা করা উচিত নয়। দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকেও ভূপাতিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তারা ড্রোন নামিয়ে এনেছে বলে মনে হয়েছিল। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের আকাশে অবাধে বিচরণ করতে সক্ষম ছিল। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা আবারও দেখিয়েছে যে, তারা বিপ্লবী গার্ড কর্পস এবং ইরানি বৈজ্ঞানীদের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে।
এগুলো সবই স্পষ্ট ব্যর্থতা ছিল। কিন্তু কোনোটিই নির্ণায়ক বলে প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০-এর দশকের ব্রিটেনের কথা ধার করে বললে, ইরানকে যা করতে হয়েছিল তা হলো, ‘শান্ত থাকুন এবং চালিয়ে যান’।
এর অর্থ ছিল, ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্রের অবিরাম স্রোত পাঠানো, এই জেনেও যে সবগুলো আকাশ থেকে ভূপাতিত হলেও, পুরো জনসংখ্যা আশ্রয়কেন্দ্রে বন্দি ছিল। পাশাপাশি ইসরায়েলের মূল্যবান ও ব্যয়বহুল অ্যারো ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ ফুরিয়ে আসছিল।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের হিসেব
ইরান এভাবে যা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটা হলো ২০ মাস যুদ্ধের পর ইসরায়েলি অর্থনীতি আর নিজেকে সামলাতে পারছিল না: দ্বিতীয় ফ্রন্টে এই অর্থক্ষয়কারী যুদ্ধ। নেতানিয়াহুর একটি দ্রুত সাফল্য প্রয়োজন ছিল এবং প্রথম দিনের সাফল্য সত্ত্বেও আর তা কখনোই আসেনি।
তা সত্ত্বেও, ট্রাম্পের নিষেধ মেনে ইসরায়েল বোমা হামলা বন্ধ করতে পারেনি। তাই আরেকটি স্পষ্ট বার্তা লাউডস্পিকারে দিতে হয়েছিল: ‘ইসরায়েল। ওই বোমাগুলো ফেলবে না। যদি ফেলো তাহলে এটি একটি বড় লঙ্ঘন।’ ট্রাম্প বড় গর্জন করেছিলেন।
আসলে যুদ্ধটি কী ছিল
কারণ শেষ পর্যন্ত, এই সংঘাত কখনোই এমন একটি পারমাণবিক বোমা কর্মসূচির সমাপ্তি সম্পর্কিত ছিল না। এই সংঘাত মূলত দুটি বর্ণনার মধ্যে একটি যুদ্ধ ছিল।
প্রথমটি সুপরিচিত। এটি এরকম: ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলা ছিল একটি কৌশলগত ভুল। আরব বা ইরানিরা ইসরায়েল ও আমেরিকার মিলিত শক্তি, এমনকি সর্বাধুনিক প্রজন্মের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলের শক্তির সাথে কখনোই তাল মেলাতে পারবে না।
ইসরায়েল সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রে তার শত্রুদের পরাজিত করবে, যেমনটি তারা ১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৭৮ এবং ১৯৮২ সালে করেছিল। আরবদের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো ইসরায়েলকে তার শর্তে স্বীকৃতি দেওয়া, যার অর্থ তার সাথে ব্যবসা করা এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিষয়টি অন্য দিনের জন্য রেখে দেওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন মাত্রায় এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে সমস্ত আরব নেতা এবং তাদের সামরিক ও নিরাপত্তা প্রধানেরা ধারণ করেন।
বিকল্প বর্ণনাটি হলো, ইসরায়েল রাষ্ট্র তার বর্তমান রূপে যতদিন থাকবে, ততদিন শান্তি থাকতে পারে না। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের উপস্থিতির বিপরীতে এটিই সংঘাতের উৎস। দখলদারত্ব যতদিন চলবে, প্রতিরোধ ততদিন থাকবে, যেই লাঠি হাতে নিক বা রাখুক না কেন।
ইসরায়েলের আধিপত্য ও জয় করার ইচ্ছাকে অস্বীকার করে ইরানের শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তার কৌশলগত রকেট বাহিনীর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা গাজার ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পণে রাজি না হওয়ার যে মনোভাব দেখিয়েছে, ইরানও তা দেখিয়েছে।
যদি যুদ্ধবিরতি টিকে থাকে, ইরানের কাছে বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার জন্য তার কোনো তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। কারণ ট্রাম্প নিজেই দুবার এই টেবিল ত্যাগ করেছেন। একবার যখন তিনি ২০১৮ সালের মে মাসে ইরানের সঙ্গে থাকা ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন। চলতি জুন মাসে আবার, যখন তাঁর দূত স্টিভ উইটকফ সরাসরি আলোচনায় যুক্ত ছিলেন।
ট্রাম্প গর্ব করে বলেছিলেন, তিনি আলোচনার মাধ্যমে ইরানিদের ধোঁকা দিয়েছেন এবং একই সময়ে ইসরায়েলকে তার হামলার প্রস্তুতি নিতে দিয়েছেন। ঠিক আছে। তবে তিনি আর সে কৌশলটি ব্যবহার করতে পারবেন না।
তেহরানের বিকল্প
আলোচনায় ফিরে আসার জন্য ইরানের গ্যারান্টি দরকার হবে যে, ইসরায়েল আর আক্রমণ করবে না–এমন গ্যারান্টি যা ইসরায়েল কখনোই দেবে না। যেমনটি আমি ও অন্যান্যরা যুক্তি দিচ্ছি, এসপিটির অংশ হওয়া ইরানের স্বার্থে খারাপ কাজ করেছে। তারা এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আবার পরমাণু বোমা তৈরির তোড়জোড় শুরু করতে পারে যাতে ইসরায়েল আর কখনো এটি না করে।
বাস্তবে, ইরানকে কিছুই করতে হবে না। তারা সর্বোচ্চ চাপের নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে ১২ দিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। তাদের কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই। এই হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা তারা পুনর্গঠন ও মেরামত করতে পারে। যদি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেখার থাকে, তাহলে এটি আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল ও সন্দেহপ্রবণতা নিজের শ্রোতার কাছে কিছু হিসাব দিতে হবে।
ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লিবারম্যানকে এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা উচিত। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন: ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা সাফল্য সত্ত্বেও সমাপ্তিটা তিক্ত। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে, আমরা এমন একটি শাসনের সাথে কঠিন আলোচনায় প্রবেশ করছি, যা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধ করবে না। তিনি বলছেন, শুরু থেকেই আমি সতর্ক করেছিলাম: আহত সিংহের চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। একটি স্পষ্ট চুক্তি ছাড়া যুদ্ধবিরতি কেবল ২-৩ বছরের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ নিয়ে আসবে–আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
ইসরায়েল গাজার হাতে তৈরি রকেটের বদলে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে। এ যুদ্ধ একটি পরোক্ষ শত্রু এবং ছায়া যোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষককে একটি সরাসরি শত্রুতে পরিণত করেছে। এই শত্রু এমনই যে, ইসরায়েলের সব মানুষকে বাঙ্কারে পাঠাতে দ্বিধা করে না। এটি একটি অর্জন, কিন্তু ১২ দিন আগে নেতানিয়াহু যা ভাবছিলেন, তা নয়।
প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলোর সবাই ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী। ফলে ইরানের কাছে তাদের বলার মতো কিছুই নেই। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক আইনে সম্পূর্ণভাবে অবৈধ একটি আক্রমণের প্রতি তাদের মেরুদণ্ডহীনতা ও সম্মতি দিয়ে তারা মধ্যস্থতা করার সমস্ত ক্ষমতা ও যোগ্যতা ত্যাগ করেছে। আবারও, তারা যে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার দাবি করে, তাকেই তারা দুর্বল করেছে।
ডেভিড হার্স্ট: মিডল ইস্ট আই-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক
(লেখাটি মিডল ইস্ট আই-এর সৌজন্যে)