আজ বিশ্ব পানি দিবস, যা পানির গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা কর্তৃক ঘোষিত ও বার্ষিকভাবে উদ্যাপিত একটি দিন। পানি জীবনের জন্য আবশ্যিক উপাদান। আমাদের এই পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ স্থল। কিন্তু পৃথিবীর মোট পানির মাত্র তিন শতাংশ পানের যোগ্য। যার ১ দশমিক ৬ শতাংশ পানি বরফ ও হিমবাহের আকারে রয়েছে এবং ০ দশমিক ৩৬ শতাংশ পানি মাটির নিচে রয়েছে।
সুষম খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে একটি হলো পানি। যদিও পানির কোনো ক্যালোরি নাই। কিন্তু মানবদেহের খাদ্য পরিপাক, পরিশোষণ, পরিবহণ, বর্জ্য পদার্থ দূরীকরণ এবং দৈহিক তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষার মত মৌলিক কাজ সম্পাদনের জন্য পানি অপরিহার্য। আবার মানবদেহের মোট ওজনের ৭০ শতাংশ পানি। জন্মের সময় এই পানির পরিমাণ থাকে প্রায় ৭৫ শতাংশ থাকে, যা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পানি কমতে থাকে এবং বৃদ্ধ বয়সে প্রায় ৫৫ শতাংশ হয়। তাছাড়া আমাদের রক্তের ৮৩ শতাংশ, মস্তিষ্কের ৭৪ শতাংশ এমনকি হাড়ের ২২ শতাংশ পানি থাকে।
প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা প্রয়োজন, তা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর। যেমন: আবহাওয়া, কাজের ধরণ, শারীরিক শ্রম, বয়স, ওজন ইত্যাদির ভিন্নতায় পানির দৈনিক চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে গরম আবহাওয়ার কারণে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। আবার শীতকালে পানি পানের ইচ্ছা কম হয়। তবে সবসময় শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান করা ভালো।
জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা–২০২০ অনুযায়ী, একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন দেড় থেকে সাড়ে ৩ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গ্লাস নিরাপদ পানি পান করা প্রয়োজন অথবা প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৪০ মিলিলিটার করে পানি পান করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ৬০ কেজি ওজনের কোনো ব্যক্তির দৈনিক পানির চাহিদা ৬০×৪০=২ হাজার ৪০০ মিলিলিটার বা ২ দশমিক ৪ লিটার। আবার অন্য পদ্ধতিতে পানির চাহিদা নির্ণয় করা যায়। উদাহরণস্বরূপ কোন ব্যক্তির ওজন যদি ৭৭ কেজি বা ১৭০ পাউন্ড হয়, তাহলে দৈনিক তার পানির চাহিদা ১৭০/২=৮৫ আউন্স বা ২ দশমিক ৫ লিটার।
তবে কিছু বিশেষ অবস্থায় পানির চাহিদা বেড়ে যায় যেমন গর্ভবতী নারী, স্তন্যদানকারী মা, খেলোয়াড়, অধিক শারীরিক পরিশ্রম করা ব্যক্তির ক্ষেত্রে। আবার কিছু বিশেষ অবস্থায় যেমন কিডনি জটিলতায় পানির চাহিদা কমে যায়।
সকালে খালি পেটে পানি পানের অভ্যাস করা খুবই ভালো। যা পাকস্থলী ও অন্ত্রের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। পানি হজম ও পুষ্টির শোষণ বাড়ায়। হালকা গরম পানি পানের অনেক উপকারিতা আছে। তবে একবারে অনেক পানি একসাথে পান করা ভালো না। বরং প্রতিদিন শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানি সারাদিনব্যাপী ভাগ করে পান করলে তা শরীরের জন্য অধিক উপকারী। তাছাড়া খাওয়ার সময় পানি খাওয়া ভালো নয়। বরং খাওয়ার ১৫ থেকে ৩০ মিনিট আগে বা পরে পানি খাওয়া ভালো। তাছাড়া খাবার কম খেতে চাইলে বা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে খাওয়ার আগে পানি পান করাই উত্তম।
তবে ভারী কায়িক শ্রম বা খেলাধুলার পর অথবা অন্য কোনো কারণে শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়ার পর একবারে অনেক বেশি পানি পান করলে শরীরের কোষের পানি ও লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। এমতাবস্থায় পানিতে সামান্য পরিমাণে লবণ মিশিয়ে অল্প অল্প করে পানি পান করা যেতে পারে।
তাই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রতিদিন অবশ্যই শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করতেই হবে। পানি কম পান করলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ফলে মাথাধরা, মনোযোগের ঘাটতি, ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া খুব কম পানি পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
তবে পাশাপাশি বাড়তি পানি পানের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। একটি সাধারণ কিডনি প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক কোয়ার্ট যা প্রায় ১ লিটারের সমান তরল পদার্থ ত্যাগ করতে পারে। এর বেশি পান পান করলে অতিরিক্ত পানি আপনার দেহে থেকে যাবে। ফলে হাইপোন্যাট্রিমিয়া হতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তাছাড়া অতিরিক্ত পানি পান করলে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বা শরীরের লবণের তারতম্য দেখা দেয় যার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার অনেক সময় শরীর অতিরিক্ত পানি ধরে রেখে ওজন বাড়ায় ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে।
লেখক: নিউট্রিশন অফিসার, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি