‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’–এই বাক্যটি দিয়ে অনেক সিনেমা‑নাটকই তৈরি হয়। আমাদের দেশে যেমন হয়, বিদেশেও হয় হরহামেশা। ওটিটি’র এই দুনিয়ায় এ ধরনের বিনোদনমূলক ভিডিও কনটেন্ট আরও বেশি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি দেশে এ নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা হলেই কি সাত খুন মাফ? ডিসক্লেইমারে এটি লিখে দিলেই কি যা খুশি দেখানো যায়? মানে ওই সত্য ঘটনাকে ইচ্ছামতো পরিবর্তনের অনুমতি মেলে কি না?
এক্ষেত্রে প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক যে, এই ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’ বলতে আসলে কী বোঝায়। হলিউড, বলিউডসহ দুনিয়ার নানা প্রতিষ্ঠিত সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই এমন চল রয়েছে। ইংরেজিতে বলে, ‘Inspired by True Events’। আবার কিছু সিনেমায় এটাও লেখা থাকে যে, ‘Based on True Events’। কি, শুনতে কিছুটা একই রকম লাগছে না? হ্যাঁ, শুনতে কাছাকাছি মনে হলেও আসলে এই দুটি বিষয় পুরোপুরি আলাদা।
‘Based on True Events’ হলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে। অর্থাৎ, যে সিনেমা বা নাটক বা ভিডিও কনটেন্টের শুরুর ডিসক্লেইমারে এমনটা লেখা থাকে, সেটির গল্প সত্য ঘটনাকে পুরোপুরি অনুসরণ করে। এতে ক্রিয়েটিভ ডিফারেন্স খুব একটা থাকেই না বা রাখা যায় না। সত্য ঘটনার মধ্যে এক্ষেত্রে ফিকশন বা কোনো কল্পনা ঢোকানো হয় না। উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন: বিশ্বখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের তৈরি একটি ক্ল্যাসিক সিনেমা হলো ‘শিন্ডলারস লিস্ট’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক সুযোগসন্ধানী এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসৎ ব্যক্তি অস্কার শিন্ডলারকে কেন্দ্রে রেখে এ সিনেমাটির গল্প এগিয়েছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে ছল করে লাখ লাখ ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন অস্কার শিন্ডলার। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন লিয়াম নিসন। এই সিনেমা একদিকে যেমন বক্স অফিসে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কারের মঞ্চেও জিতে নিয়েছিল একাধিক পুরস্কার। অর্থাৎ, সিনেমাটি সাধারণ দর্শক ও সমালোচক–সবার হৃদয়ই জয় করতে পেরেছিল।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ এমন একটি সিনেমা, যেটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, Based on True Events। অস্কার শিন্ডলার বাস্তব দুনিয়ারই একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবনের ঘটনাটাই পুরোপুরি রূপালি পর্দায় তুলে আনা হয়েছিল। এবং এক্ষেত্রে কোনো ঐতিহাসিক ভুল করার সুযোগ পরিচালক বা চিত্রনাট্যকারের থাকে না। ফলে পর্দায় অস্কার শিন্ডলাররূপী লিয়াম নিসনকে যা যা করতে দেখা গেছে, তার সবই আসলে বাস্তবের দুনিয়ায় ঘটেছে। পরিচালক এখানে কোনো কল্পনাকে স্থান দেননি। এমনকি সময়, স্থান, পাত্র ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল উপাদানের মধ্যেই যেন এই সত্যতা উপস্থিত থাকে, তাই ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ বানাতেও লেগেছে দীর্ঘ সময়, প্রায় ১০ বছর! এই সবকিছু করার মূল কারণ হলো, যেন সত্য প্রতীকরূপেও অবিকৃত থাকে। তাতে যেন খাদ ঢুকে না যায়।
অন্যদিকে ‘Inspired by True Events’ হলো ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’য় নির্মাণ। এক্ষেত্রে সত্য ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ভিন্ন ঘরানার গল্প তৈরি করা হয়। এখানে কিন্তু পরিচালক বা চিত্রনাট্যকারের এদিক‑সেদিক করার বেশ স্বাধীনতা আছে। কারণ সত্য গল্পের অনুপ্রেরণাটি নিয়ে এক ভিন্ন গল্প বা জগত তৈরি করা হয়। এতে সত্যের সঙ্গে মিল থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। এবং মিল থাকার বাধ্যবাধকতাও নেই। ফলে পরিচালক অন্য গল্প দেখাতেই পারেন।
যেহেতু আগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমা দিয়ে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তাই এবারও সেই পথেই যাওয়া যাক। সিনেমার নাম ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটিও ব্যাপক আলোচিত। বরেণ্য পরিচালক কোয়েন্টিন টারান্টিনো ছিলেন নির্মাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিটিও বক্স অফিসে ব্যাপক সফলতা পেয়েছিল, আবার কান চলচ্চিত্রে উৎসবে পুরস্কৃতও হয়েছি। এটি ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’য় নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। বাস্তব দুনিয়ার কিছু চরিত্র এতে ছিল, আবার প্রচুর কল্পিত চরিত্রও ছিল। গল্পও ফিকশনাল। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে উপজীব্য করে টারান্টিনো একটি কল্পিত জগত তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সত্যকে তুলে ধরার কোনো দায় তাঁর ছিল না।
ঠিক এভাবেই বাংলাদেশেও ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’য় এবং ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’–এই দুভাবেই সিনেমা বা নাটক বা ওটিটি কনটেন্ট তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’য় নির্মাণের দাবি করে মুক্তি পেয়েছে এমনই একটি সিনেমা, যার নাম ‘আমলনামা’। রায়হান রাফীর পরিচালনায় তৈরি সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে। অভিনয়ে আছেন জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান, কবি, গীতিকার ও নির্মাতা কামরুজ্জামান কামু, গাজী রাকায়েত, তমা মির্জা প্রমুখ।
সিনেমাটির গল্প সম্পর্কে চরকি লিখেছে, ‘বেশ কয়েক বছর হলো মাদকের ব্যবসা ছেড়েছে হাসান। স্ত্রী ও দুই কন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার। আচমকা একরাতে ‘আইনের লোক’ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় নিজ বাড়ি থেকে। পুরো পরিবারে নেমে আসে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা।’ এই বর্ণনার সঙ্গে যখন সিনেমার পোস্টারে চরিত্রের ছবির পেছনে ঝাপসা অক্ষরে লেখা ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ শব্দগুলো দেখা যায়, তখন ধারণা করাই যায় যে ‘আমলনামা’ সিনেমার গল্প ঠিক কোন পথে এগিয়েছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই সিনেমার প্রচারেও বাবার কান্নায় অস্থির হয়ে এক কন্যার মোবাইল ফোনে সেই ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসার বিষয়টিও যখন উঠে আসে, তখন আসলে ধোঁয়াশা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ এই দেশের মানুষের এখনও একটি বাক্য মনে আছে। সেটি হলো, ‘আব্বু, কান্না করতেছ যে…’। কক্সবাজারের ওয়ার্ড কমিশনার একরামুলের অপমৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। এবং এই বিষয়টির বিচারিক সুরাহা এখনও হয়নি।
ফলে দুইয়ে দুইয়ে যেমন চার হয়, তেমনি অনেক সংবাদমাধ্যমও এমন কথাই প্রচার করতে থাকে যে, কমিশনার একরামুলের ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘আমলনামা’। এমন প্রচার নিয়ে নির্মাতা বা নির্মাণকারী বা প্রচারকারী কর্তৃপক্ষের খুব একটা স্পষ্ট প্রতিবাদও দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে যখন একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম এ নিয়ে প্রতিবাদ জানান এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্ট্যাটাস লিখে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’র দাবি জানান, তখন অবশ্য নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়ে দেন যে, এটি কল্পিত একটি গল্প বা ফিকশন। আয়েশা মূলত যে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, সেটি হলো পর্দায় দেখানো চরিত্র ‘হাসান’‑এর মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। তাঁর দাবি, একরামুল কখনোই মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না এবং এর প্রমাণও নেই।
বিভ্রান্তির ব্যাপার হলো, চরকি যেসব সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘আমলনামা’‑এর খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছে, সেসবে ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’ এবং ‘সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বন’–এই দুই বিষয়েরই উল্লেখ আছে। ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’ হলে কল্পিত গল্প বানানোই যায়। সেই সৃজনশীলতা দেখাতেই পারেন নির্মাতারা। তবে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ হলে তা করা যায় না কোনোভাবেই। আর ছায়াকে কিন্তু অবলম্বন করা যায় না! ছায়া বস্তুটির সত্যিকারের ধর্মও তেমনটা নয়।
সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা বা অবলম্বন–এই দুটি বিষয় নিয়ে এর আগেও বিতর্ক উঠেছে এ দেশের বিনোদন জগতে। দেশের এক বিখ্যাত ও প্রবল জনপ্রিয় লেখকের জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরির দাবি তুলেই সেই বিতর্ক উঠেছিল। সেক্ষেত্রেও শেষে ‘অনুপ্রেরণা’তে আশ্রয় নিয়ে বিতর্কের যবনিকা পতন হয়েছিল।
আসলে সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়াটা অনৈতিক কিছু নয়। তা নিয়ে কনটেন্ট বানানোর অধিকারও নির্মাতাদের আছে। তবে এর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি কেমন হবে, সেটি নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। যেমন: ‘আমলনামা’র ক্ষেত্রেই যেভাবে বাবার কান্নায় অস্থির হওয়া কন্যার সঙ্গে মোবাইল ফোনে সেই বাবার জীবনের শেষ অধ্যায়ের আলাপের বিষয়টি উঠে এসেছে, সেক্ষেত্রে আসলে দেশের আমজনতার পক্ষে দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলা অস্বাভাবিক নয়। যে দেশে ফেসবুকে চিলের কান নিয়ে যাওয়ার পোস্ট দেখেই অনেক মানুষ বাস্তবের দুনিয়ায় চিলের পেছনে ছুটতে থাকে অক্লেশে, সে দেশে ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা’ ও ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’র তফাতটা আরেকটু স্থূল হওয়া প্রয়োজন। সেটি যেমন নির্মাণে, তেমনি প্রচারেও। নইলে অনেক ফিকশনরেও ইট‑কাঠের সমাজে বাজে প্রভাব বা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার তাগৎ জন্মে যায়। ওতে কারও কারও জীবনে উটকো ঝামেলা ও অস্বস্তিও তৈরি হতে পারে বৈকি!
আসলে দিনশেষে সবারই সমাজ ও মানুষের প্রতি কিছু দায়িত্ব থাকে। চিত্রপরিচালক, গল্পকার ও শিল্পীদের তো অবশ্যই থাকে। আর সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিলে, সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সত্যিকারের মানুষগুলোর প্রতিও থাকে। তাই বাইরের দেশে নাটক‑সিনেমা বা সিরিজ তৈরিতে যেসব সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়, সেগুলোও প্রায় সময়ই দূর অতীতের হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিছুটা প্রমাণিত সত্য ঘরানার হয়। এতে করে অন্তত দর্শকদের ধন্ধে পড়তে হয় না। তৈরি হয় না অযাচিত বিতর্কও। তবে বিতর্ক তৈরিই যদি অন্যতম উদ্দেশ্য হয়, সেটি ভিন্ন বিষয়। এই পুঁজিবাদী দুনিয়ায় তেমন ইচ্ছা হওয়াটাও আসলে অস্বাভাবিক তো নয়!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]