নারীর প্রতি শ্লীলতাহানি নানাভাবে হতে পারে। ইংরেজি ‘Modesty’ শব্দের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘শ্লীলতা’। ইংরেজি ‘Modesty’ বেশ কিছু অর্থে ব্যবহৃত হলেও বাংলা ‘শ্লীলতা’ শব্দটি দিয়ে সাধারণভাবে বোঝানো হয়ে থাকে ‘সম্ভ্রম’। আর তাই শ্লীলতাহানির মানে দাঁড়ায় সম্ভ্রমহানি।
নারীর শ্লীলতাহানি বিষয়ে বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর একাধিক ধারায় উল্লেখ আছে।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারার বিধানমতে, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন স্ত্রীলোকের শ্লীলতাহানির অভিপ্রায়ে বা সে তদ্বারা তার শ্লীলতাহানি হতে পারে জেনে তাকে আক্রমণ করে বা তৎপ্রতি অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে, তাহলে সে ব্যক্তি যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
নারীর প্রতি অপরাধসমূহ কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্যে প্রণীত বাংলাদেশের বিশেষ আইন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১০ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তা হলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং তার জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
দণ্ডবিধিতে বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘শ্লীলতা’ শব্দের যেহেতু কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা নেই, তাই এর আভিধানিক এবং প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত। আর সে অনুযায়ী যে আচরণ কোন নারীর সম্ভ্রম বা সম্মানের প্রতি অবমাননাকর বা হুমকিস্বরূপ, তাকেই আমরা শ্লীলতাহানির সংজ্ঞায় ফেলতে পারি।
যে কোনো ধরনের বাজে কথা, কাজ, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি, আঘাত, আক্রমণ, কোনো বস্তু বা চিহ্ন প্রদর্শন, গোপনীয়তার অনধিকার লঙ্ঘনসহ নানা উপায়ে নারীর শ্লীলতাহানি করা যায় বা নারীকে উত্ত্যক্ত করা যায়। যারা এ ধরনের অপরাধ কোনো নারীর সঙ্গে করবে, তাদেরকে দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী বিনাশ্রম কারাদণ্ড- যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। তবে এ ধরনের অপরাধে শাস্তি দিতে হলে সবার আগে সামাজিক ভয় ও সংকোচকে পাশ কাটিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে এগিয়ে এসে অভিযোগ জানাতে বা মামলা করতে হবে।
নারী উত্ত্যক্তকারীরা নানা কৌশলে নারীদের বা নিতান্ত কম বয়সী মেয়েদেরও শ্লীলতাহানি বা উত্ত্যক্তকরণ করে থাকে। ফলে এ অপরাধ প্রমাণ করা বেশির ভাগ সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের অপরাধকে অনেক অপরাধ গবেষক ‘ছোটোখাটো ধর্ষণ’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং সেটা অনেকাংশেই সঠিক। নারীর শ্লীলতাহানির নানান ধরন ও বৈশিষ্ট্য থেকে পুরুষের এক ধরনের ধর্ষকামী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে, যা হয়তো নির্দিষ্ট কোন আইনি সংজ্ঞায় ফেলা না গেলেও খুব সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে।
অপরাধ যত ছোটই হোক না কেন, শুরু থেকে সোচ্চার না হলে তা এক সময় দানবীয় রূপ ধারণ করতে পারে। যেমন নারীর সাধারণ শ্লীলতাহানির অবাধ সুযোগ ও পরিবেশ থেকে অপরাধী সাহস করতে পারে ধর্ষণ, এসিডসন্ত্রাস, খুন বা নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার মতো অপরাধ সংগঠিত করতে।
সম্প্রতি রাজধানীর লালমাটিয়ায় সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে মব সৃষ্টি এবং শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ওড়না পরিধান বিষয়ে এক যুবকের হুঁশিয়ারি প্রদানের যে নমুনা দেখা গেল এবং কতিপয় মতাদর্শের বা চিন্তার অনুসারীদের আবার এই দুই ঘটনার অপরাধীদের পক্ষে যেভাবে অবস্থান নিতে দেখা গেল, তা নিঃসন্দেহে নারী সম্পর্কিত প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাগুলোর প্রতি হুমকিস্বরূপ। এভাবে চলতে থাকলে নারীর চলাফেরা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অচিরেই আরও কঠোর আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে এ সংক্রান্ত আওয়াজ উঠছে।
কেউ কেউ নারীর শ্লীলতাহানি বা নারীকে উত্ত্যক্তকরণ থেকে রেহাই পেতে নারীদের রক্ষণশীল পোশাক পরিধান বিষয়ে উৎসাহিত করেন বা তা না পরাকে দায়ী করেন। তবে রক্ষণশীল পোশাক পরিহিত নারীরাও যে পথেঘাটে, পাবলিক পরিবহনে, জনসমাগম স্থানে শ্লীলতাহানির বা উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়ে থাকেন তার অগণিত উদাহরণ অবশ্য আবার এরাই এড়িয়ে চলেন। অনেকে ধর্মীয় দোহাই দিয়ে অপরাধীর অপরাধপ্রবণতাকে হালকাভাবে দেখতে চান। তবে যে বা যারাই, যে অজুহাত বা দোহাই দিয়েই নারীকে অপমান, দমন, পীড়ন, নির্যাতন বা শ্লীলতাহানির চেষ্টা করবে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে উদাহরণ সৃষ্টি করা রাষ্ট্র তথা সরকারের দিক থেকে আবশ্যিক। তাদেরকে সামাজিকভাবে নিন্দা জানানো হবে সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য। অন্যথায় দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে দেশ গঠনের নানামুখী কাজে নারীদের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তা ব্যাহত হবে আর লঙ্ঘিত হবে মানুষ হিসেবে নারীর প্রাপ্য প্রয়োজনীয় মানবাধিকার।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট