বৃষ্টিমুখর এক রাত। ঝরঝর করে ঝরে চলেছে। ছোট্ট বাসার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল এক ছেলে। হঠাৎ সে দেখল তার বাবাকে। সাথে ছিল আরও ৩ জন। তারা কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল চাটাইয়ে মোড়ানো এক লাশ। সেই লাশের পায়ে ছিল সুন্দর এক জোড়া নূপুর!
প্রায় ৪০ বছর আগের এই ঘটনাই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বেরিয়ে আসে আজকের দুনিয়ায়। আর তাতেই এক জটিল রহস্য যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে। আর কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে। পুলিশ পড়ে ধন্ধে। ওদিকে শুরু হয় একের পর এক খুন!
এমন প্রেক্ষাপটেই এগিয়ে যায় ‘রেখাচিত্রম’। ভারতের মালায়লম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি এই সিনেমাটি হলে মুক্তি পেয়েছে গত জানুয়ারি মাসে। এরপর থেকেই বক্স অফিসে দাপট দেখিয়ে গেছে। মাত্র ৯ কোটি রুপি বাজেটে তৈরি এই সিনেমা এখনও পর্যন্ত ব্যবসা করেছে ৫০ কোটি রুপিরও বেশি। বক্স অফিসের পাশাপাশি সমালোচকদের মনও জয় করেছে রেখাচিত্রম। সিনেমা হল পার হয়ে সিনেমাটি এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও মুক্তি পেয়েছে। সনি লিভ–এ দেখা যাচ্ছে রেখাচিত্রম।
গল্প কীভাবে শুরু হয়েছে, তা এতক্ষণে আমাদের জানা হয়ে গেছে। রাতের আঁধারে লাশ সরানোর সেই ঘটনা দিয়ে সিনেমার শুরু। এরপর আবার ৪০ বছর পরের বর্তমানে ফিরে আসা হয়। সেখানে একদিকে দেখা মেলে অনলাইনে জুয়া খেলে বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বিবেক গোপীনাথের। অন্যদিকে, রাজেন্দ্রান নামের এক বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তির গভীর জঙ্গলে ঢুকে রহস্যজনক আচরণ করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে ফেসবুক লাইভে এসে রাজেন্দ্রান জানায় ৪০ বছর আগে এক নারীকে জঙ্গলে পুঁতে রাখার ঘটনা। পুঁতে রাখার জায়গাও দেখিয়ে যায় সে। এবং এর পরপরই ফেসবুক লাইভেই আত্মহত্যা করে রাজেন্দ্রান। এই আত্মহত্যার ঘটনার তদন্তের ভার আবার এসে পড়ে সদ্য কাজে ফেরা বিবেকের ওপর। তদন্তের ক্ষেত্রে তার হাতে সম্বল কেবল একটি কঙ্কাল, আর অনেকগুলো প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসে হৃদয়বিদারক এক কাহিনী।
রেখাচিত্রম পরিচালনা করেছেন জোফিন টি. চাকো। এর আগে ২০২১ সালে ‘দ্য প্রিস্ট’ নামের এক সিনেমা বানিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি। এবারের সিনেমাতেও একই অবস্থা। সাধারণ দর্শক থেকে সমালোচক—সবাই রেখাচিত্রম-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যমে ঝড় তুলেছে এ সিনেমা।
মিস্ট্রি-থ্রিলার ঘরানার এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আসিফ আলি, অনস্বরা রাজন, মনোজ কে. জায়ানসহ আরও অনেকে। তবে মূল চরিত্র, অর্থাৎ পুলিশ কর্মকর্তা বিবেকের ভূমিকায় ছিলেন আসিফ। সত্যি বলতে, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে কীভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা শেখার ক্ষেত্রে আসিফ আলি এক অনন্য উদাহরণ। এত স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় দেখাটাও এক অনুপম অভিজ্ঞতা। আর আসিফকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন অন্যান্য অভিনয়শিল্পীরা। তবে প্রায় ১৪০ মিনিটের সিনেমাটি এক অর্থে একাই টেনে নিয়ে গেছেন আসিফ। অথচ তাতেও সিনেমার টানটান উত্তেজনায় ভাটা পড়েনি একটুও।
রেখাচিত্রম-এর সিনেমাটোগ্রাফি দারুণ ছিল। স্বভাবতই মালায়লম চলচ্চিত্রে সবুজের আধিক্য থাকে। এই সিনেমাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর সাথে দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। ফলে কোথাও বেখাপ্পা লাগেনি একেবারেই।
গহীন জঙ্গলে পুঁতে রাখা লাশ, আত্মহত্যা, খুন—এত কিছুর ভিড়ে রেখাচিত্রম আসলে একটা মেয়ের কথা বলে। একেবারে সাধারণ একটা মেয়ে। রূপালী জগতের নায়কের সে অন্ধ ভক্ত। একটা ভিউ কার্ডে অটোগ্রাফ পাওয়ার জন্য সে পাগলপ্রায়। স্বপ্ন দেখে নায়িকা হওয়ার। ওই উঠতি বয়সে যেমনটা হয়। কিন্তু একদম সাদাসিধে (কিছু ক্ষেত্রে অলীক!) স্বপ্নও কখনো কখনো পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। হয়তো স্বপ্নের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠার পথে পরিণতি ভোগ করা কারও হাতও থাকে না সেভাবে। অন্যের লোভেরই বলি হয়ে যেতে হয় স্রেফ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সব!
রেখাচিত্রম ঠিক তেমন এক বাস্তবতার সামনেই দর্শকদের দাঁড় করায়। রহস্য-রোমাঞ্চের ভিড়ে, এক ফাঁকে চোখের কোণে জড়ো করে কয়েক ফোঁটা জলও। মনে হয়, ৪০ বছর ধরে গহীন জঙ্গলে মাটির নিচে হারিয়ে থাকা ‘নিখোঁজ’ মেয়েটির চাওয়া কি সত্যিই খুব বেশি ছিল?