‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’–নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের এই সংলাপ জনজীবনে বহুলভাবে চর্চিত। ঈদুল আজহায় মুক্তিপ্রাপ্ত রায়হান রাফীর ‘তান্ডব’ দেখেও সংলাপটির কথাই যেন মনে পড়ে! বিশেষ করে সুপারস্টার শাকিব খান যখন পর্দায় ‘স্বাধীন’ কিংবা ‘মিখাইল’ রূপে দেখা দেন। চরিত্র দুটির অতীতজুড়ে রয়েছে নানা বাঁকবদল। একসময় দর্শকেরা জানতে পারেন–কে এই স্বাধীন? তার আসল পরিচয় কী? নাকি যে স্বাধীন, সে-ই মিখাইল? শাকিবের চরিত্রে এমন জটিল সমীকরণের দেখা মেলে।
সিনেমাটির শুরু একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে মুখোশ-পরা অস্ত্রধারী একদল ব্যক্তির হামলার মধ্যদিয়ে। মানুষের মুখে মুখে তখন এই খবর। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তটস্থ সবাই! জিম্মিদের উদ্ধার করতে তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছ থেকে আক্রমণকারীদের সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে লাইভ শো-তে ডেকে নেওয়া হয় ধর্মমন্ত্রীসহ কয়েকজনকে। তাদের আলাপ-আলোচনায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে থাকা সত্য কাহিনি।
ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে স্বাধীনের জীবনের গল্প। বেকারজীবন, ব্যর্থ প্রেম ও প্রেমিকার আত্মহত্যা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে অপহরণের পর তাকে নির্মম নির্যাতনের নানা ঘটনা। বলা যেতে পারে, নিজের জীবনের অন্ধকার এক আখ্যান পর্দায় বর্ণনা করে চরিত্রটি। যেসব ঘটনায় তার বুকে বাসা বেঁধেছে প্রতিশোধের আগুন কিংবা সহজ-সরল স্বাধীন থেকে নৈরাজ্যবাদী একটি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা বনে যাওয়ার আত্মকাহিনি! জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতই স্বাধীনকে অন্য এক মানুষে পরিণত করেছে। সাহস যুগিয়েছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
নির্মাতা রায়হান রাফী তান্ডব সিনেমার গল্পে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অতি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্যপট। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা ‘বলপূর্বক অপহরণ’ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে এ সিনেমায়। এমনকি ‘তান্ডব’‑এর মুখ্য চরিত্রের সংলাপেও সমসাময়িকতার প্রতিফলন ঘটে, যা রায়হান রাফীর সিনেমার মৌলিক স্বর বলেই পরিচিত! কেননা, এর আগেও তাঁর নির্মিত বিভিন্ন সিনেমায় সমসাময়িক অনুষঙ্গের ছাপ দেখা গেছে, তান্ডব-ও তার ব্যতিক্রম নয়।
সিনেমাটিতে শাকিবের অভিনয়-দক্ষতা দর্শকের চোখে পড়ার মতো। কণ্ঠস্বরেও অচেনা এক শাকিবকে দেখা যায়! তান্ডব-এ তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন অভিনেত্রী সাবিলা নূর। বড় পর্দায় তাঁর অভিষেক দুর্দান্তই বলা যায়। ‘লিচুর বাগানে’ আইটেম গানে কিছুটা সমালোচনার জায়গা থাকলেও নিশাত-রূপী সাবিলার অভিনয়কে ‘সাবলীল’ ছাড়া ভিন্ন কিছু বলার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে, এই সিনেমায় দর্শকের উন্মাদনায় মেতে ওঠার মতো বহু রসদ রেখেছেন রাফী। প্রেক্ষাগৃহে সেসব মুহূর্তে শাকিব খান, আফরান নিশো ও সিয়াম আহমেদ-ভক্তদের উল্লাসধ্বনি একটা সিনেমাকে যথেষ্ট আনন্দমুখর করে তোলে। এ ছাড়া ক্যামিও চরিত্রে নিশো-সিয়ামকে বেছে নেওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যেমন যুগান্তকারী এক অধ্যায়, তেমনই তা চমকপ্রদ।
পর্দায় অভিনেত্রী জয়া আহসান রয়েছেন প্রথিতযশা এক সাংবাদিকের ভূমিকায়। অভিনয়ে তিনি বরাবরের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত। এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, মুকিত জাকারিয়া, গাজী রাকায়েত, এফ এস নাঈম, সুমন আনোয়ার, তারিক আনাম খান, ডা. এজাজ, ফজলুর রহমান বাবু, সুব্রত প্রমুখ। নির্মাতা চাইলে এই জাঁদরেল অভিনেতাদের ক্ষেত্রে আরও বিস্তৃত পরিসরে অভিনয়ের জায়গা রাখতে পারতেন!
সিনেমাটির শুরু থেকেই সিনেমাটোগ্রাফি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন দৃশ্য ব্যতিক্রমভাবে ধারণ করার ক্যারিশমা দেখিয়েছেন চিত্রগ্রাহক শিহাব নুরুন নবী। আবহসংগীতে মনের আরাম দিয়েছেন আরাফাত মহসিন নিধি।
তবে শেষার্ধে এসে কেমন যেন খুব দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে প্রেক্ষাপট! যেখানে আরও কিছুটা ডিটেইলিং-এ যেতে পারতেন নির্মাতা। কারণ, শেষ পর্যন্ত ‘স্বাধীন’ কিংবা ‘মিখাইল’র আদর্শগত জায়গায় যে দ্বিচারিতা দর্শকের সামনে আসে, সেখানে আরেকটু ব্যাকগ্রাউন্ড তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে হয়। হয়তো তান্ডব’র সিক্যুয়েলে তা উঠে আসবে! তবে রাফীকে তান্ডব-এ পাওয়া গেছে ঠিক রাফীর মতো করেই।