ইরানের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাসের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের মধ্যে চরম বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও এবারই প্রথম এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটল। এর ফলে ইসরায়েল–ইরান সংঘাত সারা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত শনিবার রাতে ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের একটি প্রধান জ্বালানি ডিপোতে হামলা করেছে ইসরায়েল। এ ছাড়া রাজধানী তেহরানের আরেকটি তেল শোধনাগারেও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। একই সময়ে কাতার সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্র ‘সাউথ পার্স’–এর উৎপাদন স্থগিত করে ইরান। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত।
গত ১৩ জুন ভোররাত ৩টার দিকে ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি পক্ষে বলা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে ইসরায়েল ও এর বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রসহ ড্রোন হামলার আশঙ্কা থেকে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা চালানো হয়েছে। ওই হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। জবাবে ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইরানও।
আজ চতুর্থ দিনে গড়াল ইরান–ইসরায়েলের সংঘাত। ইসরায়েলের হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছে। আর ইসরায়েলে ইরানের হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ১৩ জন।
ইরানের কোন কোন জ্বালানি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) জানিয়েছে, ইরান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতকারী দেশ। এ ছাড়া ইরান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মজুতকারী দেশ। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোগুলোকে নিশানায় রেখেছে ইসরায়েল। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের চাপের কারণে এতদিন ইসরায়েল এই স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে, ইরানের জ্বালানি স্থাপনাগুলো ধ্বংস হলে সারা বিশ্বের জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিই হুমকির মুখে পড়বে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অবশেষে ইসরায়েল হামলা করেই বসল এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ইন্ধনেই।
গত শনিবার রাতে ইরানের শাহরান জ্বালানি ও গ্যাস ডিপোতে এবং তেহরান রিফাইনারিতে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ হামলার কথা স্বীকার করেছে।
এ ছাড়া বুশেহর প্রদেশের উপকূলে অবস্থিত সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে ইরানের দুই-তৃতীয়াংশ গ্যাস উৎপাদিত হয়। ইরান এই গ্যাসক্ষেত্রটি প্রতিবেশি দেশ কাতারের সঙ্গে পরিচালনা করে। ইরানের অংশে এটির নাম ‘নর্থ ফিল্ড’।
ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েল ইরানের ফেজ–১৪ প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকিয়াকরণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদন করে ইরান।
অন্য আরেকটি হামলায় ইসরায়েল ইরানের ফাজর জাম গ্যাস প্ল্যান্টে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। এই প্ল্যান্টটি সাউথ পার্স থেকে পাওয়া জ্বালানি প্রক্রিয়াজাত করে।
জ্বালানি স্থাপনাগুলো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
শাহরান তেল ডিপোর ধারণক্ষতা প্রায় ২৬ কোটি লিটার। এর মাধ্যমে উত্তর তেহরানের বিভিন্ন টার্মিনালে পেট্রোল, ডিজেল এবং বিমানের জ্বালানি (অ্যাভিয়েশন ফুয়েল) সরবরাহ করা হয়।
এদিকে তেহরান রিফাইনারির ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ২৫ হাজার ব্যারেল। এটি ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল শোধনাগার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল শোধানাগার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ইরানের সবচেয়ে জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে।
অন্যদিকে সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে আনুমানিক ১ হাজার ২৬০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস রয়েছে, যা বিশ্বের মোট মজুতের প্রায় ২০ শতাংশ। ইসরায়েলি হামলার কারণে এই গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ইরান।
আর বুশেহর প্রদেশে অবস্থিত ফজর-ই-জাম গ্যাস শোধনাগারটিও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ইসরায়েলি হামলার কারণে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ইরানে ব্ল্যাকআউট বা লোডশেডিংয়ের কারণে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
অস্থিতিশীল হতে পারে বিশ্ববাজার
ইসরায়েল হামলা বন্ধ না করলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান। ইরান যদি সত্যই এই পদক্ষেপ নেয়, তাহলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
হরমুজ প্রণালী হচ্ছে, পারস্য উপসাগরে প্রবেশের একমাত্র সামুদ্রিক পথ। এ পথ দিয়ে বিশ্বের মোট তেল ব্যবহারের প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয়। এই প্রণালীর একপাশে রয়েছে ইরান এবং অন্যপাশে রয়েছে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) এটিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহনের চোকপয়েন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
গত ১৩ জুন ইরানের ইসরায়েলি হামলার পরপরই তেলের দাম ৯ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এখন তেলের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, আজ সোমবার থেকে তেলের দাম আবার ঊর্ধ্বমূখী হবে।